ক্লাসে শত তত্ত্ব, কিন্তু বাস্তব জীবনে শূন্য; শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের দাবি উঠছে !

ক্লাসে শত তত্ত্ব, কিন্তু বাস্তব জীবনে শূন্য; শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের দাবি উঠছে !
ছবির ক্যাপশান, ক্লাসে শত তত্ত্ব, কিন্তু বাস্তব জীবনে শূন্য; শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের দাবি উঠছে !
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ক্লাসে শত তত্ত্ব, কিন্তু বাস্তব জীবনে শূন্য; শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের দাবি উঠছে ! আজকের পৃথিবীতে ডিগ্রি ও সার্টিফিকেট যত সহজে পাওয়া যায়, জীবনের বাস্তবতা বোঝা তত কঠিন হয়ে উঠছে। একজন শিক্ষার্থী হয়তো গণিত, পদার্থবিদ্যা বা অর্থনীতি ভালো জানে, কিন্তু চাপ সামলানো, সিদ্ধান্ত নেওয়া বা সম্পর্ক রক্ষা করার মতো মৌলিক জীবনদক্ষতা তার নেই, এটাই এখনকার শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সংকট। বিশ্বজুড়ে শিক্ষাবিদরা এখন বলছেন, "একজন মানুষ কেবল তখনই শিক্ষিত, যখন সে জানে কীভাবে সঠিকভাবে বাঁচতে হয়।" এই কারণেই 'লাইফ স্কিল' বা জীবনদক্ষতা শিক্ষা এখন শুধু ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বরং একটি মানবিক ও সামাজিক প্রয়োজন।

'লাইফ স্কিল' আসলে কী এবং কেন তা জরুরি?

'লাইফ স্কিল' শব্দটা অনেকেই ব্যবহার করেন, কিন্তু এর অর্থ আরও গভীর।  এটি এমন একগুচ্ছ মানসিক, সামাজিক ও আচরণগত দক্ষতা যা একজন মানুষকে চিন্তা করতে, সিদ্ধান্ত নিতে, অনুভূতি বুঝতে ও অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে সাহায্য করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো "লাইফ স্কিল এডুকেশন"কে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানায়। তারা চিহ্নিত করে ১০টি মূল জীবনদক্ষতা:

১। আত্মজ্ঞান (Self-awareness)

২। সহানুভূতি (Empathy)

৩। কার্যকর যোগাযোগ (Effective Communication)

৪। সম্পর্ক বজায় রাখা (Interpersonal Relationship)

৫। সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Decision Making)

৬। সমস্যা সমাধান (Problem Solving)

৭। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা (Creative Thinking)

৮। সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking)

৯। মানসিক চাপ মোকাবিলা (Coping with Stress)

১০। আবেগ নিয়ন্ত্রণ (Coping with Emotions)

এই দক্ষতাগুলো মানুষকে শুধু পরীক্ষায় নয়, জীবনের প্রতিটি বাস্তব পরীক্ষায় সফল হতে সাহায্য করে।

কেন শুধুমাত্র বইয়ের জ্ঞান যথেষ্ট নয়?

আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে জ্ঞান ইন্টারনেটে সহজলভ্য, কিন্তু মানবিক বুদ্ধিমত্তা (Emotional Intelligence) পিছিয়ে পড়ছে। একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি হয়তো প্রযুক্তিতে পারদর্শী, কিন্তু

‌> কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর সঙ্গে মতবিরোধ মেটাতে জানেন না,

> ব্যর্থতার সময় মনোবল ধরে রাখতে পারেন না,

> পরিবার বা সমাজে সহানুভূতিশীল আচরণ দেখাতে পারেন না।

ফলে তৈরি হয় এক "অসচেতন শিক্ষিত প্রজন্ম", যারা জানে অনেক কিছু, কিন্তু বোঝে খুব কম।
এই শিক্ষার ঘাটতি পূরণ করে লাইফ স্কিল এডুকেশন, যা শেখায় কীভাবে নিজের ও সমাজের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে এগিয়ে যেতে হয়।

কারিকুলামে নতুন ভাবনা কেন দরকার?

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও পরীক্ষানির্ভর ও মুখস্থকেন্দ্রিক।
ছাত্ররা যত ভালোই মুখস্থ করুক, তাতে তাদের চিন্তাশক্তি, বিচারবুদ্ধি বা মানসিক স্থিতিশীলতা গড়ে ওঠে না। এ কারণেই শিক্ষাব্যবস্থায় এখন প্রয়োজন "নলেজ ট্রান্সফার" থেকে "স্কিল ডেভেলপমেন্ট"-এর দিকে যাওয়া। কারিকুলামে লাইফ স্কিল অন্তর্ভুক্ত করা মানে,  শিক্ষার্থীদের শেখানো- 

☞ কীভাবে ব্যর্থতার পরও ইতিবাচক থাকা যায়,

☞ কীভাবে দলগতভাবে কাজ করতে হয়,

☞ কীভাবে নিজের অনুভূতি ও রাগ-ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়,

☞ কীভাবে ডিজিটাল জগতে দায়িত্বশীল থাকা যায়।

এগুলো শেখানো না হলে সমাজে তৈরি হবে তথ্যপ্রবাহিত কিন্তু মানবিকভাবে দুর্বল এক প্রজন্ম।

 ফিনল্যান্ডে, 'Phenomenon-Based Learning' পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সমস্যা বিশ্লেষণ করে শিখে সিদ্ধান্ত নিতে। জাপানের স্কুলে, "Moral Education" বাধ্যতামূলক, যেখানে ছাত্ররা দলবদ্ধভাবে কাজ, দায়িত্ব ভাগাভাগি ও সহমর্মিতা শেখে। ভারতে,  ইউনিসেফ ও রাজ্য সরকার মিলে "Adolescent Life Skill Program" চালু করেছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ মোকাবিলা, আত্মসম্মান ও যোগাযোগ শেখানো হয়। এই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, লাইফ স্কিল শিক্ষা শুধু মানবিকতা নয়, অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতাও বাড়ায়, কারণ দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী ও ইতিবাচক মানুষ কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের মূল চালিকা শক্তি।

 বাংলাদেশেও  জাতীয় শিক্ষাক্রম  শিক্ষার্থীর "যোগ্যতা-ভিত্তিক শিক্ষা"কে প্রাধান্য দিয়েছে।
এখানে শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সহমর্মিতা, নৈতিকতা ও সামাজিক আচরণ মূল্যায়নের অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়

অনেক শিক্ষক এখনো লাইফ স্কিল বিষয়টি শেখানোর প্রশিক্ষণ পাননি।
আবার, পাঠ্যবইয়ে বাস্তব জীবনের উদাহরণ বা প্র্যাকটিক্যাল মডিউলও পর্যাপ্ত নয়। পরিবার ও সমাজেও এখনো 'মানসিক শিক্ষা'কে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাই লাইফ স্কিল শিক্ষা সফল করতে হলে শুধু স্কুল নয়, পরিবার, মিডিয়া ও সমাজকেও এই সংস্কৃতিতে অংশ নিতে হবে।

প্রযুক্তিনির্ভর যুগে লাইফ স্কিলের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়েছে।
আজকের তরুণদের শেখাতে হবে

☞ কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় দায়িত্বশীলভাবে আচরণ করতে হয়,
☞ কীভাবে সাইবার বুলিং বা অনলাইন স্ট্রেস মোকাবিলা করতে হয়,

☞ কীভাবে ডিজিটাল ডিটক্স বা ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন সম্ভব, এবং 

☞ কীভাবে প্রযুক্তিকে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়।

এই নতুন প্রজন্মের লাইফ স্কিল শিক্ষা হবে "ডিজিটাল ইন্টেলিজেন্স" ও "ইমোশনাল রেজিলিয়েন্স"-এর মিশ্রণ।

একটি সমাজ তখনই টেকসই ও মানবিক হয়, যখন তার মানুষরা কেবল তথ্য জানে না, বরং অনুভব করতে শেখে। লাইফ স্কিল শিক্ষা তাই কেবল ভবিষ্যতের নয়, বর্তমান সময়েরও জরুরি চাহিদা। একজন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ সেই, যে নিজের আবেগ বুঝে, অন্যের কষ্ট অনুভব করে, এবং কঠিন সময়েও স্থির থাকতে পারে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাই সময় এসেছে বইয়ের পাতার বাইরে তাকানোর। কারণ জীবনের বাস্তবতা বোঝা ছাড়া শিক্ষা কেবল তথ্যের স্তূপ।
যেমন বলা হয়

"Education is not the learning of facts, but the training of the mind to think." — আলবার্ট আইনস্টাইন।  আজ আমাদের সেই ভাবনার দিকেই ফিরতে হবে যেখানে থাকবে - জীবনের জন্য শিক্ষা, শিক্ষার জন্য নয়।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ