পৃথিবীর সেই অদ্ভুতুরে স্থান, যেখানে কম্পাসও বিভ্রান্ত হয়- জানেন কি এর রহস্য?

পৃথিবীর সেই অদ্ভুতুরে স্থান, যেখানে কম্পাসও বিভ্রান্ত হয়- জানেন কি এর  রহস্য?
ছবির ক্যাপশান, পৃথিবীর সেই অদ্ভুতুরে স্থান, যেখানে কম্পাসও বিভ্রান্ত হয়- জানেন কি এর রহস্য?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

পৃথিবীতে দিক নির্ধারণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যন্ত্র হলো কম্পাস, যা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে উত্তর ও দক্ষিণের দিক নির্দেশ করে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো পৃথিবীতে এমন কিছু স্থান রয়েছে, যেখানে এই কম্পাস সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়! এই ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা বলেন "Geomagnetic Anomaly" বা ভৌগোলিক চৌম্বক বিভ্রাট। অর্থাৎ, পৃথিবীর কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় চৌম্বক ক্ষেত্রের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়, ফলে কম্পাস ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।

পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে রয়েছে গলিত লোহা ও নিকেল দিয়ে গঠিত এক তরল স্তর, যাকে বলা হয় outer core। এই গলিত ধাতব পদার্থের চলাচল থেকেই সৃষ্টি হয় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্র আমাদের বায়ুমণ্ডলকে সূর্যের বিকিরণ থেকে রক্ষা করে এবং কম্পাসকে দিক নির্দেশনায় সাহায্য করে। কিন্তু কিছু অঞ্চলে এই চৌম্বক প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে, যার ফলে কম্পাস দিক নির্ধারণে ব্যর্থ হয় বা ভুল দেখায়।

এমন কিছু স্থান, যেখানে কম্পাস 'ভুল' বলে-

১. নর্থ ও সাউথ ম্যাগনেটিক পোল (Magnetic Poles): পৃথিবীর চৌম্বক উত্তর ও দক্ষিণ মেরু, দুই স্থানেই কম্পাস প্রায় অকেজো। কারণ, এখানে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের রেখাগুলো উল্লম্বভাবে নেমে আসে, ফলে সূচকটি সঠিকভাবে ঘুরতে পারে না। এই স্থানগুলোতে কম্পাসের দিক নির্দেশনা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর হয়।

২. বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল (Bermuda Triangle): উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিমাংশে অবস্থিত এই কুখ্যাত অঞ্চলকে ঘিরে রহস্য প্রচুর। বহু পাইলট ও নাবিক জানিয়েছেন, এখানে কম্পাস হঠাৎ করে দিক পরিবর্তন করে বা স্থির থাকে না। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এখানে চৌম্বক বিচ্যুতি (magnetic declination) অস্বাভাবিক রকমের বেশি, যার কারণে যন্ত্রপাতির পাঠ বিকৃত হয়।

৩. মাউন্ট আইডা ও স্টোন মাউন্টেন (যুক্তরাষ্ট্র): এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে লোহা ও ম্যাগনেটাইট খনিজ রয়েছে। ফলে স্থানীয় চৌম্বক শক্তি পৃথিবীর মূল ক্ষেত্রকে ব্যাহত করে কম্পাস দেখায় এক দিক, কিন্তু বাস্তবে দিকটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

৪. ইয়াকুটস্ক, সাইবেরিয়া (রাশিয়া): এই অঞ্চলের ভূগর্ভে রয়েছে বিশাল খনিজ ও ধাতব জমা, বিশেষত লৌহ আকরিক ও নিকেল। এই ধাতব স্তরগুলো স্থানীয়ভাবে চৌম্বক প্রবাহ সৃষ্টি করে, যার কারণে কম্পাস কয়েক ডিগ্রি থেকে শুরু করে কয়েকশ' ডিগ্রি পর্যন্ত ভুল দেখাতে পারে।

৫. এরিয়া ৫১ (নেভাদা, যুক্তরাষ্ট্র): বিখ্যাত এই সামরিক ঘাঁটির চারপাশেও অস্বাভাবিক চৌম্বক বিভ্রাট লক্ষ্য করা যায় বলে একাধিক গবেষণায় উল্লেখ আছে। এটি হয়তো ভূগর্ভস্থ ধাতব গঠন বা সামরিক প্রযুক্তিগত পরীক্ষার কারণে।

কেন কম্পাস এখানে কাজ করে না?

কম্পাসের সূচক পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে নিজেকে সামঞ্জস্য করে।
কিন্তু যখন কোনো অঞ্চলে-  

ভূগর্ভে ধাতব খনিজের ঘনত্ব বেড়ে যায়, অথবা স্থানীয় চৌম্বক প্রবাহের দিক ও তীব্রতা পরিবর্তিত হয়, তখন সেই অঞ্চল হয়ে ওঠে "চৌম্বক বিভ্রান্ত এলাকা" (Magnetic Disturbance Zone)।

এছাড়াও, সূর্যের বিকিরণ বা সৌরঝড় (solar storm) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও আয়নোস্ফিয়ারে প্রভাব ফেলে, যার ফলে সাময়িকভাবে কম্পাস বা ন্যাভিগেশন সিস্টেমে ভুল দেখা দিতে পারে।

এই চৌম্বক বিভ্রাট শুধু কম্পাস নয়, প্রভাব ফেলে বিমানের ন্যাভিগেশন, জাহাজের দিকনির্দেশনা, স্যাটেলাইট ও GPS সিস্টেমেও।
বিমানচালকরা এই এলাকাগুলো পার হওয়ার সময় "Magnetic Variation Correction" ব্যবহার করেন, যাতে চৌম্বক বিভ্রাটের কারণে দিকনির্দেশের ভুল কমানো যায়।

বিজ্ঞানীরা এই ধরনের অঞ্চলকে বলেন "Geomagnetic Anomaly Zone",
যা ভূগর্ভস্থ খনিজ, লাভা প্রবাহ ও পৃথিবীর কেন্দ্রীয় গঠন বোঝার জন্য অমূল্য তথ্য দেয়। এই গবেষণার মাধ্যমেই পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন, চৌম্বক মেরুর স্থানান্তর এবং সৌর প্রভাব বিশ্লেষণ সম্ভব হয়েছে।

পৃথিবী শুধু একখণ্ড পাথর বা জল নয়। এটি এক জীবন্ত চৌম্বক ক্ষেত্রের বলয়।
যেখানে মেরু পরিবর্তন, ধাতব গঠন ও সৌর প্রভাব মিলিয়ে তৈরি হয় অদ্ভুত চৌম্বক রহস্যের জাল। কম্পাসের সূচক যখন থমকে যায়, তখন বিজ্ঞান আমাদের শেখায়, দিক হারানো মানেই বিপদ নয়, বরং সেটাই হয়তো নতুন কোনো রহস্য উন্মোচনের শুরু।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ