সানবার্ন কীভাবে তৈরি হয়, শরীরে কী ঘটে, এবং কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা যায়!

সানবার্ন কীভাবে তৈরি হয়, শরীরে কী ঘটে, এবং কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা যায়!
ছবির ক্যাপশান, সানবার্ন কীভাবে তৈরি হয়, শরীরে কী ঘটে, এবং কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা যায়!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

রোদে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই ত্বকে হালকা টান, জ্বালা বা পোড়া পোড়া অনুভূতি হয়, অনেকেই এটাকে সাধারণ ঘটনা মনে করেন। কিন্তু এই সামান্য তাপেই লুকিয়ে থাকতে পারে ত্বকের গভীর ক্ষতি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে বলা হয় সানবার্ন (Sunburn) যা এক ধরনের ত্বকের প্রদাহ, যা সূর্যের অতিবেগুনি (Ultraviolet) রশ্মির আঘাতে ঘটে। অদৃশ্য এই রশ্মি ত্বকের কোষে প্রবেশ করে DNA-তে পরিবর্তন আনে, কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে ত্বকের অকাল বার্ধক্য (photoaging) কিংবা এমনকি ত্বক ক্যানসারের ঝুঁকি পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে।

সূর্যের আলো তিন ধরনের রশ্মি নিয়ে গঠিত UVA, UVB ও UVC।

◑ UVC পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পৌঁছায় না, কারণ ওজোনস্তর তা শোষণ করে নেয়।

◑ UVA রশ্মি ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে এবং কোলাজেন ও ইলাস্টিন ফাইবার ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফল ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয় ও বলিরেখা দেখা দেয়।

◑ UVB রশ্মিই মূলত ত্বক পোড়ার কারণ। এটি ত্বকের বাইরের স্তর এপিডার্মিস-এ আঘাত হানে, কোষের DNA ভেঙে দেয়, যার ফলে শরীর প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া (inflammatory response) শুরু করে।

এই প্রতিক্রিয়াই আমাদের চোখে লালচে, ফুলে যাওয়া, জ্বালাযুক্ত ত্বক হিসেবে ধরা পড়ে, যাকে আমরা বলি সানবার্ন।

সানবার্ন কেবল বাইরের পোড়া নয়, বরং এটি শরীরের ভেতরে শুরু হওয়া এক জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া। ত্বকের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো 'cytokine' ও 'prostaglandin' নামের রাসায়নিক বার্তা ছড়ায়, যা রক্তনালীগুলো প্রসারিত করে। ফলে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়, ত্বক লাল হয়ে ফোলে।
এই অবস্থায় শরীর চেষ্টা করে ক্ষতিগ্রস্ত কোষ অপসারণ ও নতুন কোষ তৈরি করতে। তাই কয়েকদিন পর দেখা যায় ত্বক উঠতে শুরু করে। এটি শরীরের আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যদি ক্ষতির মাত্রা বেশি হয়, ত্বকে ফোসকা, ব্যথা, জ্বর, ডিহাইড্রেশন এমনকি শকের মতো প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যা চিকিৎসা প্রয়োজনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়।

দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: সানবার্নের ক্ষতি অনেক সময় চোখে দেখা যায় না, কিন্তু কোষের ভেতরে ঘটে DNA মিউটেশন। এই পরিবর্তিত কোষগুলো সময়ের সঙ্গে ত্বক ক্যানসার (Skin Cancer)-এর ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষত যাদের নিয়মিত রোদে কাজ করতে হয়, যেমন কৃষক, নির্মাণকর্মী বা ক্রীড়াবিদদের। এছাড়া, photoaging-এর কারণে ত্বক অকালেই নিস্তেজ, রুক্ষ ও কুঁচকে যায়।

কারা বেশি ঝুঁকিতে?

⇨ যাদের ত্বক ফর্সা বা হালকা রঙের

⇨ যাদের পরিবারে ত্বকের রোগের ইতিহাস আছে

⇨ নিয়মিত রোদে কাজ করতে হয়।  যেমন -মাঠে, সমুদ্রে, রাস্তায়।

⇨ শিশুরা, কারণ তাদের ত্বক পাতলা ও সংবেদনশীল।

⇨ যারা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ, যেমন - অ্যান্টিবায়োটিক বা রেটিনয়েডস, সেবন করছেন যা ত্বককে UV রশ্মির প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে

প্রতিরোধ:  চিকিৎসা গবেষণায় দেখা গেছে, সানবার্ন প্রতিরোধযোগ্য, যদি কিছু নিয়ম প্রতিদিন মানা হয়।

১️. সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন নিয়মিত: SPF (Sun Protection Factor) 30 বা তার বেশি হোক। রোদে যাওয়ার ২০–৩০ মিনিট আগে লাগাতে হবে। দুই ঘন্টা পর পুনরায় লাগাতে হবে, বিশেষত ঘাম বা পানির সংস্পর্শে এলে।

২️. পোশাকে সুরক্ষা: সূর্যরোধী কাপড় (sun-protective clothing) পরুন। প্রশস্ত কিনারাযুক্ত টুপি ও সানগ্লাস ব্যবহার করুন। হালকা রঙের, ঢিলেঢালা পোশাক পরা উত্তম- গাঢ় রঙ তাপ শোষণ করে বেশি গরম করে তোলে।

৩️. সময় নির্বাচন: সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সূর্যের রশ্মি সবচেয়ে তীব্র থাকে। এ সময় বাইরে যাওয়া এড়িয়ে চলুন বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন।

৪️. খাদ্যাভ্যাসে সুরক্ষা: অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার, যেমন - ভিটামিন সি, ই, বিটা-ক্যারোটিনযুক্ত ফল-সবজি ইত্যাদি, ত্বকের কোষকে UV ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। শসা, টমেটো, গাজর, তরমুজ, সবুজ চা ও জলসমৃদ্ধ ফল ত্বককে ভেতর থেকে ঠান্ডা রাখে।

চিকিৎসা ও যত্ন: 

☞ রোদে পোড়া অংশে হালকা ঠান্ডা পানি বা ভেজা কাপড় চেপে রাখলে জ্বালা কমে।

☞ অ্যালোভেরা বা অ্যালো ক্রিম ব্যবহারে ত্বক ঠান্ডা রাখে ও প্রদাহ কমায়।

☞ ময়েশ্চারাইজার, ক্ষতিগ্রস্ত কোষের পুনর্গঠন ত্বরান্বিত করে।

☞  সানবার্নে শরীরের পানিশূন্যতা হয়, তাই প্রচুর পানি, ফলের রস, ডাবের পানি গ্রহণ জরুরি।

☞ চামড়া টানবেন না।খোসা ওঠা অংশ জোরে টানলে সংক্রমণ হতে পারে।

☞ গুরুতর ক্ষেত্রে (ফোসকা, জ্বর, মাথা ঘোরা) চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

সানবার্ন বনাম ভিটামিন–ডি:  রোদ থেকে শরীরে ভিটামিন–ডি উৎপন্ন হয় যা হাড়ের জন্য অপরিহার্য। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন সকালে ১৫–২০ মিনিট রোদে থাকা যথেষ্ট। দীর্ঘসময় রোদে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই, বরং এটি ত্বকের ক্ষতি ও কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ায়। অর্থাৎ, রোদ আমাদের বন্ধু, কিন্তু শর্ত একটাই- পরিমিতি বজায় রাখতে হবে।

সূর্য পৃথিবীর প্রাণের উৎস, কিন্তু তার তীব্রতা উপেক্ষা করলে সেই আলোই হতে পারে বিপজ্জনক। আজকের এই জলবায়ু পরিবর্তন, ওজোনস্তরের ক্ষয় এবং গ্রীষ্মের দীর্ঘ সময় সানবার্নকে আরও সাধারণ করে তুলেছে। তাই নিজের ত্বকের যত্ন নেওয়া এখন বিলাসিতা নয়, বরং এক প্রকার আত্মরক্ষা। রোদে বেরোবেন, কিন্তু সচেতনভাবে। কারণ, প্রকৃত সৌন্দর্য ত্বকের রঙে নয়,  তার সুস্থতায়।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ