সাইকোসিসের ভেতরের জগত: কারণ, লক্ষণ এবং মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত পরিবর্তন !

সাইকোসিসের ভেতরের জগত: কারণ, লক্ষণ এবং মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত পরিবর্তন !
ছবির ক্যাপশান, সাইকোসিসের ভেতরের জগত: কারণ, লক্ষণ এবং মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত পরিবর্তন !
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ভাবুন, হঠাৎ করে চারপাশের শব্দ, দৃশ্য বা মানুষের আচরণ আপনার কাছে অন্যরকম লাগছে। কেউ আপনাকে নজর রাখছে বলে মনে হচ্ছে, অথচ বাস্তবে কেউ নেই। এই মানসিক অবস্থা যখন চিন্তা, অনুভূতি ও বাস্তববোধের সীমা ঘুলিয়ে ফেলে, তখন তাকে বলা হয় সাইকোসিস (Psychosis)। এটি কোনো "পাগলামি" নয়, বরং একধরনের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাধি, যেখানে একজন মানুষ সাময়িকভাবে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মনোরোগবিদ্যার দৃষ্টিতে, সাইকোসিস একটি অবস্থা (state), এটি নিজে কোনো নির্দিষ্ট রোগ নয়, বরং বিভিন্ন মানসিক রোগের একটি লক্ষণ।

সাইকোসিস  যেভাবে কাজ করে-

সাইকোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তি এমন কিছু শোনেন, দেখেন বা বিশ্বাস করেন যা বাস্তবে নেই। এই অবস্থায় মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াজাত করার স্বাভাবিক ব্যবস্থা (information processing system) বিঘ্নিত হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের মস্তিষ্কে কোটি কোটি স্নায়ুকোষের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান হয় 'ডোপামিন' নামের এক রাসায়নিক বার্তার মাধ্যমে। যখন এই ডোপামিনের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় বা ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন বাস্তব আর কল্পনার সীমা গুলিয়ে যায়।  ফলেই দেখা দেয় hallucination (অবাস্তব জিনিস দেখা/শোনা) ও delusion (অবাস্তব বিশ্বাস)।

লক্ষণ: 

সাইকোসিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে দেখা দেয়, কিন্তু অবহেলা করলে দ্রুত তীব্র আকার নিতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য 

☞ হ্যালুসিনেশন (Hallucination): বাস্তবে না থাকা শব্দ শোনা, কাউকে দেখা, বা স্পর্শ অনুভব করা। যেমন - কেউ বলছে তার মাথার ভেতরে "কণ্ঠস্বর" শোনা যায়।

☞ ডিলিউশন (Delusion): বাস্তবতার বাইরে কোনো দৃঢ় বিশ্বাস। যেমন - কেউ মনে করছে, কেউ তাকে ক্ষতি করতে চাইছে, বা সে কোনো বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী।

☞ বিচ্ছিন্ন চিন্তা (Disorganized thinking): কথাবার্তায় অসংলগ্নতা, এক বিষয় থেকে আরেকটিতে লাফিয়ে যাওয়া।

☞ অস্বাভাবিক আচরণ: অযথা হাসা-কাঁদা, নিজের সঙ্গে কথা বলা, বা সামাজিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলা।

☞ বাস্তববোধের ক্ষতি (Loss of insight): আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় বুঝতে পারেন না যে তিনি অসুস্থ।

কেন ঘটে সাইকোসিস?

সাইকোসিসের পেছনে একক কোনো কারণ নেই; এটি সাধারণত জৈবিক, মানসিক ও পরিবেশগত কারণের সমন্বয়ে ঘটে।

⇨ জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব: পরিবারে যদি কারও সাইকোসিস বা স্কিজোফ্রেনিয়ার ইতিহাস থাকে, ঝুঁকি বাড়ে।

⇨ মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা: ডোপামিন, গ্লুটামেট ইত্যাদি নিউরোট্রান্সমিটার-এর অস্বাভাবিকতা সাইকোসিসের মূল ভূমিকা রাখে।

⇨ মানসিক চাপ ও ট্রমা: প্রিয়জন হারানো, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা এ অবস্থার ট্রিগার হতে পারে।

⇨ নেশাজাতীয় পদার্থের ব্যবহার: বিশেষ করে ক্যানাবিস, এলএসডি, কোকেইন বা অ্যামফেটামিন জাতীয় ড্রাগ সাইকোসিসের সম্ভাবনা বাড়ায়।

⇨ ঘুমের অভাব ও ঘন মানসিক ক্লান্তি: মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পেলে বাস্তব উপলব্ধির প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়।

সাইকোসিস সবসময় একই রকম নয়! সাইকোসিস কোনো একক রোগ নয়, বরং এটি বিভিন্ন মানসিক অবস্থার অংশ হতে পারে:

◑ স্কিজোফ্রেনিয়া: দীর্ঘস্থায়ী সাইকোটিক ডিসঅর্ডার, যেখানে হ্যালুসিনেশন ও বিভ্রম স্থায়ী হয়।

◑ বাইপোলার ডিসঅর্ডার: ম্যানিক বা ডিপ্রেসিভ পর্যায়ে সাইকোসিস দেখা দিতে পারে।

◑ মেজর ডিপ্রেশন উইথ সাইকোটিক ফিচারস: তীব্র হতাশার সঙ্গে বাস্তববোধ হারিয়ে ফেলা।

◑ সাবস্ট্যান্স-ইনডিউসড সাইকোসিস: মাদক সেবনের কারণে তৈরি সাইকোটিক প্রতিক্রিয়া

গবেষণায় দেখা গেছে, সাইকোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, যা যুক্তি, সিদ্ধান্ত ও বিচারবোধ নিয়ন্ত্রণ করে, তা তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয় থাকে। অন্যদিকে, লিম্বিক সিস্টেম, যা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, অতিসক্রিয় হয়ে পড়ে।
ফলে বাস্তবতার বিচার ও আবেগের ভারসাম্য হারায়। এই কারণেই আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের বিশ্বাস বা কণ্ঠস্বরকে সম্পূর্ণ বাস্তব বলে মনে করেন।

চিকিৎসা: 

সাইকোসিস চিকিৎসাযোগ্য,  তবে শুরুর পর্যায়ে শনাক্ত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসার ধাপগুলো সাধারণত তিনভাবে হয়:

⇨ ওষুধ (Antipsychotic medication): ডোপামিনের ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে বিভ্রম ও হ্যালুসিনেশন কমাতে সাহায্য করে।

⇨ সাইকোথেরাপি (Cognitive Behavioral Therapy): রোগীকে বাস্তবতা চিনতে, চিন্তার ধরণ বুঝতে ও ভয়-ভীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

⇨ পরিবার ও সামাজিক সহায়তা: আক্রান্ত ব্যক্তি যেন একা না বোধ করেন, এটাই পুনরুদ্ধারের সবচেয়ে বড় শক্তি। সহানুভূতিপূর্ণ পরিবেশ তার মস্তিষ্কে নিরাপত্তার অনুভূতি ফিরিয়ে আনে।

সচেতনতা: 

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় মানসিক রোগ নিয়ে এখনো সামাজিক কুসংস্কার প্রচলিত।
অনেকে মনে করেন, "এই সব সমস্যা ইচ্ছাশক্তির অভাব", বা "জ্বিনের প্রভাব"-যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সাইকোসিস কোনো অপরাধ নয়, এটি এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা, যেমন ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ শারীরিক সমস্যা। চিকিৎসা, সহানুভূতি ও সচেতন সমাজ - এই তিনের সমন্বয়েই একজন মানুষ ফিরতে পারেন বাস্তব জীবনের আলোয়।

সাইকোসিসের সময় মানুষ বাস্তবতা হারায়, কিন্তু চিকিৎসা ও সমর্থনে সে আবার ফিরে আসতে পারে। মন যদি বিভ্রমে ঢেকে যায়, আলো দেখানোর দায়িত্ব তখন সমাজ ও পরিবারকেও নিতে হয়। কারণ মানসিক সুস্থতাই মানবতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ