'Life of Pi'(2012): ভয় আর বিশ্বাসের মাঝখানে টিকে থাকার মানবিক মহাকাব্য

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
২০১২ সালের চলচ্চিত্র "Life of Pi" শুধুমাত্র এক কিশোরের সমুদ্রযাত্রার গল্প নয়, বরং এটি এক গভীর দার্শনিক যাত্রা, মানুষের অন্তর্দৃষ্টি, ভয়, সাহস ও বিশ্বাসের সীমা পরীক্ষা করার কাহিনি। পরিচালক আং লি এই সিনেমার মাধ্যমে যেন মানুষের অস্তিত্ব, ঈশ্বরবিশ্বাস ও মানসিক সহনশীলতার এক বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক মিশ্রণ তুলে ধরেছেন।
ভারতের এক তরুণ ছেলে পাই প্যাটেল (Piscine Molitor Patel), যার নাম নিয়েও শুরু হয়েছিল তার সহপাঠীদের হাসাহাসি। একসময় পরিবারের সঙ্গে কানাডাগামী জাহাজে ওঠে। কিন্তু মাঝ সমুদ্রে ঝড় তাদের জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। পাই একা বেঁচে থাকে একটি নৌকায়, সঙ্গে থাকে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, রিচার্ড পার্কার। একই নৌকায় মানুষ ও বাঘের সহাবস্থান, যা অসম্ভব মনে হলেও গল্পটি আসলে জীবনের সংগ্রাম, ভয় ও বিশ্বাসের প্রতীক।
এই সিনেমা মূলত শেখায় "survival psychology", মানে বেঁচে থাকার মনোবিজ্ঞান। যখন মানুষ চরম বিপদের মুখে পড়ে, তখন তার মস্তিষ্ক "fight or flight" প্রতিক্রিয়া চালু করে। পাই-এর মধ্যে আমরা সেই 'fight' মানসিকতাই দেখি। সে অজানা সমুদ্রে, ভয়ঙ্কর প্রাণীর পাশে থেকেও টিকে থাকার পথ খুঁজে নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ভয় বা বিপদের সময় যাদের মধ্যে বিশ্বাস ও লক্ষ্য থাকে, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। পাই প্রতিদিন নিজের মধ্যে বিশ্বাসের আলো জ্বালিয়ে রাখে, কখনও ঈশ্বরের প্রতি, কখনও নিজের প্রতি।
এই বিশ্বাসই তাকে মানসিকভাবে দৃঢ় রাখে, যা একপ্রকার "psychological resilience" বা মানসিক সহনশীলতা।
ছবির শেষাংশে পাই দুটি গল্প বলে একটি বাস্তবিক, একটি প্রতীকী।
কোনটি সত্য, তা দর্শকের ব্যাখ্যার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
এই দ্বৈততা আসলে এক গভীর প্রশ্ন তোলে, সত্যকে কি আমরা কেবল বাস্তব হিসেবে দেখি, নাকি বিশ্বাসের চোখে?
এটি একধরনের মনস্তাত্ত্বিক রূপক যা দেখায়, মানুষ নিজের কষ্টকে অনেক সময় বিশ্বাসের পর্দায় ঢেকে দেয়, যাতে মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকে। যেমন, পাই নিজের ট্রমাকে একটি কাহিনির মধ্যে ঢেকে রাখে, যেন বাস্তবতার অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
'Life of Pi'-এর নৌকা আসলে একটি ক্ষুদ্র পৃথিবী, যেখানে মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতির মধ্যে টানাপোড়েন চলে। বাঘটি (রিচার্ড পার্কার) এখানে মানুষের অন্তর্নিহিত ভয়, প্রবৃত্তি ও টিকে থাকার প্রবল ইচ্ছার প্রতীক। পাই যখন বাঘটিকে ভয় পেতে শিখে, তখনই সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। অর্থাৎ, ভয়কে দমন নয়,ভয়ের সঙ্গে সহাবস্থানই সাহসের প্রকৃত রূপ।
শিক্ষণীয় বার্তা:
☞ সাহস মানে ভয় না পাওয়া নয়, ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করা।
☞ বিশ্বাস মানে অন্ধ ভরসা নয়, বরং আশা ধরে রাখার শক্তি।
☞ টিকে থাকা মানে শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা।
এই সিনেমা এক অদ্ভুতভাবে দর্শককে শেখায় যতক্ষণ আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি, ততক্ষণ কোনো ঝড়ই আমাদের পুরোপুরি ভাঙতে পারে না।
"Life of Pi" আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের প্রতিটি সংগ্রাম আসলে আত্ম-আবিষ্কারের একটি ধাপ। আমরা সবাই একেকজন পাই, আমরা আমাদের নিজস্ব রিচার্ড পার্কারের সঙ্গে লড়ছি। সমুদ্র যেমন অনিশ্চিত, তেমনি জীবনও; কিন্তু বিশ্বাস, সাহস ও মানসিক স্থিতিই মানুষকে টিকিয়ে রাখে প্রতিটি ঝড়ে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।