'পিনাট বাটার' থেকে হীরা!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে হীরা শুধু একটি রত্ন নয়; এটি ক্ষমতা, ভালোবাসা, শাশ্বততা এবং বিজ্ঞানের প্রতীক। যে উপাদানটি পৃথিবীর গভীরে কোটি বছরের চাপ ও তাপে সৃষ্টি হয়, সেটিকেই আজ আমরা আংটি, মুকুট বা শিল্পকলার মাধ্যমে বহন করি। তবে আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে, আশ্চর্য হলেও সত্য যে এই অনন্ত সৌন্দর্যের পাথরটি তৈরি করা সম্ভব এমন এক সাধারণ খাদ্য থেকে, যা হয়তো আপনার রান্নাঘরেই আছে- পিনাট বাটার।
হীরার হাজার বছরের পথচলা:
প্রাচীন ভারতের হীরা: হীরার ইতিহাস শুরু হয় প্রাচীন ভারত থেকেই। খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতেই ভারতের নদী ও খনি অঞ্চল থেকে হীরা উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। তখন এগুলোকে ধর্মীয় প্রতীক, সৌভাগ্যের তাবিজ বা রাজকীয় অলংকার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। 'আরথশাস্ত্র'-এ এমনকি হীরার মান নির্ধারণের নিয়মও উল্লেখ আছে।
গ্রিক ও রোমান যুগে:
গ্রিকরা হীরাকে বলতো Adamas - অর্থ "অপরাজেয়"। তারা বিশ্বাস করতো এটি দেবতাদের অশ্রু বা পতনশীল তারার টুকরো।
রোমান সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে হীরা বহন করত সাহসের প্রতীক হিসেবে।
মধ্যযুগ ও ইউরোপীয় রাজপরিবারে:
১৪শ শতাব্দীতে ইউরোপে হীরা বিলাসবহুল শ্রেণির প্রতীক হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের রাজপরিবারে 'Hope Diamond' ও 'Koh-i-Noor'–এর মতো রত্নের প্রচলন রাজকীয় মর্যাদা নির্ধারণ করত। আজও এপ্রিল মাসের জন্মরত্ন হিসেবে এবং ভালোবাসার প্রতীক (বিশেষ করে এনগেজমেন্ট রিংয়ে) হীরা অপরিহার্য।
হীরা কীভাবে তৈরি হয়!
হীরা মূলত বিশুদ্ধ কার্বনের (C) স্ফটিক আকার। গ্রাফাইটও কার্বন, কিন্তু হীরা ও গ্রাফাইটের পার্থক্য তাদের অণুর বিন্যাসে। হীরায় কার্বনের পরমাণুগুলো ঘনভাবে চতুর্মুখী (tetrahedral) বিন্যাসে যুক্ত থাকে, যা একে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন প্রাকৃতিক পদার্থে পরিণত করেছে।
গঠনের পরিবেশ:
অবস্থান: পৃথিবীর ম্যান্টলের প্রায় ১৫০–২০০ কিলোমিটার গভীরে
তাপমাত্রা: প্রায় ১২০০–২২০০°C
চাপ: ৪৫–৬০ কিলোবার (প্রায় ১.৩ মিলিয়ন গুণ বেশি)-এই পরিস্থিতিতে কার্বন স্ফটিক হয়ে হীরায় রূপ নেয়। পরবর্তীতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে এটি 'কিম্বারলাইট পাইপ' নামক আগ্নেয় শিলাস্তরে উপরের দিকে উঠে আসে।
হীরা উত্তোলন:
আজও হীরা উত্তোলনের প্রধান উৎস দেশগুলো হলো: দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া, বতসোয়ানা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া।
আধুনিক ল্যাবে হীরা তৈরির দুই প্রযুক্তি
হীরার চাহিদা, পরিবেশগত প্রভাব ও খনি-শ্রমের সমস্যার কারণে বিজ্ঞানীরা এখন কৃত্রিম হীরা (Lab-Grown Diamond) উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছেন।
১️। HPHT (High Pressure High Temperature) পদ্ধতি:
এই প্রযুক্তিতে প্রাকৃতিক অবস্থার অনুকরণ করা হয়। গ্রাফাইট বা কার্বনকে রাখা হয় ধাতব অনুঘটকসহ একটি চেম্বারে। তাপমাত্রা বাড়ানো হয় ১৫০০°C পর্যন্ত। চাপ প্রয়োগ করা হয় প্রায় ৬০ কিলোবার পর্যন্ত। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই হীরা স্ফটিক আকারে জমাট বাঁধে।
২️। CVD (Chemical Vapor Deposition) পদ্ধতি:
এটি আরও উন্নত ও নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি। মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের মাধ্যমে হাইড্রোজেন ও মিথেন গ্যাস ভেঙে কার্বন পরমাণু মুক্ত করা হয়। কার্বনগুলো ধীরে ধীরে স্ফটিক আকারে জমে হীরায় পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় অমিশ্রণ কম থাকায় হীরার মান অনেক বেশি।
পিনাট বাটার থেকে হীরা তৈরির চমক
জার্মানির University of Bayreuth–এর ভূবিজ্ঞানী ড. ড্যান ফ্রস্ট (Dan Frost) পৃথিবীর অভ্যন্তরের উপাদানগত রসায়ন নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি জানতেন হীরা গঠনে মূল উপাদান হলো কার্বন, আর পিনাট বাটারও কার্বনে সমৃদ্ধ।
পরীক্ষার প্রক্রিয়া:
পিনাট বাটারকে রাখা হয় একটি ডায়মন্ড অ্যানভিল সেল–এ (যেখানে দুইটি হীরার পাতের মাঝে পদার্থকে অত্যন্ত উচ্চচাপে রাখা যায়)। সেলটির তাপমাত্রা বাড়ানো হয় ১৫০০°C–এরও বেশি। কয়েক সপ্তাহের পরীক্ষার পর দেখা যায়- পিনাট বাটারের কার্বন আস্তে আস্তে স্ফটিক আকারে রূপ নিচ্ছে।
ফলাফল:
অবশেষে, কয়েক মিলিমিটার আকারের ক্ষুদ্র হীরা তৈরি হয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়, শুধুমাত্র পিনাট বাটারের কার্বন থেকে। যদিও এই হীরা বাণিজ্যিক মানের নয়, তবে এটি প্রমাণ করেছে- যেকোনো কার্বন উৎস থেকেই সঠিক পরিস্থিতিতে হীরা তৈরি সম্ভব।
ড. ফ্রস্টের এই গবেষণা মূলত পৃথিবীর অভ্যন্তরের রাসায়নিক প্রক্রিয়া বোঝার জন্য ছিল।
তিনি বলেন "যখন পৃথিবীর গভীরে অক্সিজেন, সিলিকন ও কার্বন মিলিত হয়, তখন তারা একে অপরের সাথে বিক্রিয়া করে হীরা গঠন করে। পিনাট বাটার পরীক্ষা আমাদের সেই রাসায়নিক প্রক্রিয়াটিকে মাইক্রো লেভেলে দেখার সুযোগ দেয়।" এই গবেষণা ভূবিজ্ঞান, রসায়ন ও উপাদানবিজ্ঞান তিন ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, হীরার বৈশ্বিক বাজারমূল্য প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কৃত্রিম হীরার বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতি বছর প্রায় ১০–১৫% হারে।
হীরা কোটি বছর ধরে পৃথিবীর গভীরে জন্ম নিয়েছে, আজ তা তৈরি হচ্ছে মানুষের ল্যাবে, এমনকি এক চামচ পিনাট বাটার দিয়েও! মানব মেধা প্রকৃতির সীমা অতিক্রম করতে পারে, তবুও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও কৌতূহল থেকেই জন্ম নেয় বিজ্ঞানের প্রকৃত বিস্ময়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।