চোখে জ্বালা অনুভূত হলে সতর্ক হোন এক্ষুনি, হতে পারে বড় ঝুঁকির ইঙ্গিত!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের ব্যস্ত জীবনে প্রায় সবারই একটা সাধারণ অভিযোগ - চোখে জ্বালা, চুলকানি বা ভারী লাগা। অনেকেই ভাবেন এটি সাময়িক ক্লান্তি বা ঘুমের অভাবের ফল, কিন্তু আসলে চোখের জ্বালাভাব শরীর ও পরিবেশ, দুইয়েরই নানা ইঙ্গিত বহন করে। চোখ হলো মানবদেহের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গগুলোর একটি। প্রতিটি চোখের পৃষ্ঠে থাকে একধরনের পাতলা অশ্রুপর্দা (tear film), যা কর্নিয়াকে আর্দ্র রাখে, ধুলোবালি বা জীবাণু থেকে রক্ষা করে এবং দৃষ্টিকে স্বচ্ছ রাখে। কিন্তু এই সুরক্ষা স্তরটি নষ্ট হলে বা কমে গেলে চোখে শুরু হয় জ্বালা, পোড়া অনুভূতি এবং শুষ্কতা।
মানব চোখের বাইরের স্তর হলো : কর্নিয়া,যা সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশগুলোর একটি। এটি সর্বদা একটি অতি সূক্ষ্ম অশ্রুপর্দা (tear film) দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। এটি তিনটি স্তরে বিভক্ত
১️। বাইরের লিপিড স্তর, যা অশ্রু বাষ্পীভবন রোধ করে।
২। মাঝের জলীয় স্তর, যা অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে।
৩️। ভেতরের মিউসিন স্তর, যা অশ্রুকে কর্নিয়ার ওপর মসৃণভাবে ছড়িয়ে রাখে।
যখন এই স্তরগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হয়, চোখে আর্দ্রতা কমে যায়, অশ্রু দ্রুত শুকিয়ে যায়, বা ধুলাবালি প্রবেশ করে- তখনই চোখে শুরু হয় জ্বালাভাব, ঝাঁঝ বা পোড়া অনুভূতি।
চোখ জ্বালার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি হলো "ডিজিটাল আই স্ট্রেইন" বা "কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম"। গড়ে একজন মানুষ এখন দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় কাটায় মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটার বা টিভি স্ক্রিনের সামনে।
গবেষণায় দেখা গেছে, স্ক্রিনে একটানা তাকিয়ে থাকলে মানুষের চোখের পলক ফেলার হার স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। ফলে অশ্রু সমানভাবে ছড়াতে পারে না, কর্নিয়া শুষ্ক হয়ে পড়ে। এই অবস্থাতেই চোখে জ্বালা, ঝাঁঝ, ভারী লাগা, কখনও কখনও মাথাব্যথা বা দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। অফিসের এয়ার কন্ডিশন, কৃত্রিম আলো এবং দীর্ঘ সময় অনবরত কাজ, সব মিলে চোখের আর্দ্রতাকে আরও দ্রুত কমিয়ে দেয়।
শহুরে জীবনে চোখ জ্বালার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বায়ুদূষণ। বায়ুতে থাকা সালফার ডাই–অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, ওজোন ও সূক্ষ্ম ধূলিকণাগুলো চোখের অশ্রুপর্দার সঙ্গে বিক্রিয়া করে রাসায়নিক জ্বালা তৈরি করে। বিশেষত— যানবাহনের ধোঁয়া, নির্মাণকাজের ধুলো, কীটনাশকের ক্ষুদ্র কণা ও ঘরের সুগন্ধি স্প্রে বা ডিটারজেন্ট- সবকিছুই চোখের মিউকাস ঝিল্লিকে উত্তেজিত করে, যার ফলে চোখ লাল হয়ে যায় ও জ্বালাভাব বাড়ে।
খাদ্যাভ্যাস ও শরীরের ভূমিকা-
চোখের আর্দ্রতা ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে খাদ্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের ঘাটতি (যেমন মাছ, ফ্ল্যাকস সিড বা বাদামে পাওয়া যায়) অশ্রুগ্রন্থির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। ভিটামিন এ-র অভাব কর্নিয়া শুকিয়ে ফেলে, যা চোখে তীব্র জ্বালা বা অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা শরীর থেকে তরল কমিয়ে দেয়, যার প্রভাব পড়ে চোখের অশ্রু উৎপাদনেও। অন্যদিকে, কিছু ওষুধ—যেমন অ্যান্টিহিস্টামিন, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, ঘুমের ওষুধ বা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ- চোখের শুষ্কতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
অভ্যন্তরীণ কারণ ও রোগসংক্রান্ত সম্পর্ক-
চোখের জ্বালাভাব কখনও অটোইমিউন রোগের ইঙ্গিতও হতে পারে। যেমন
◑ সজোগ্রেন সিনড্রোমে শরীরের ইমিউন সিস্টেম অশ্রু ও লালা উৎপাদনকারী গ্রন্থিকে আক্রমণ করে, ফলে চোখ একেবারে শুষ্ক হয়ে যায়।
◑ হরমোনের পরিবর্তন, বিশেষ করে মেনোপজের পর নারীদের মধ্যে, অশ্রু নিঃসরণ হ্রাস করে।
◑ অ্যালার্জিক কনজাংকটিভাইটিস–এ ধূলা, ফুলের রেণু বা প্রাণীর লোমে সংবেদনশীলতা তৈরি হয়, যার ফলে চোখ ফুলে যায়, জ্বালা করে এবং পানি পড়ে।
প্রতিরোধ ও যত্নের উপায়-
চোখের জ্বালা রোধে চিকিৎসা নয়, সচেতনতা ও জীবনযাপনের পরিবর্তনই সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।
☞ "২০–২০–২০ নিয়ম" অনুসরণ করুন। প্রতি ২০ মিনিট স্ক্রিন ব্যবহারের পর ২০ সেকেন্ডের জন্য অন্তত ২০ ফুট দূরে তাকান। এতে চোখের পেশি আরাম পায় ও পলক ফেলার হার স্বাভাবিক হয়।
☞ পর্যাপ্ত পানি পান করুন, যাতে শরীর ও চোখ দুটোই আর্দ্র থাকে।
☞ ঘরে আর্দ্রতা বজায় রাখুন, বিশেষ করে এসির ঘরে 'হিউমিডিফায়ার' ব্যবহার করুন।
☞ চোখে সরাসরি বাতাস লাগা এড়িয়ে চলুন। ফ্যান, এসি বা মোটরবাইকের হাওয়া চোখ শুকিয়ে দেয়।
☞ পুষ্টিকর খাবার( যেমন -গাজর, পালং শাক, মাছ, ডিমের কুসুম ও বাদামে থাকা ভিটামিন এ ও ওমেগা–৩ চোখের পুষ্টি বজায় রাখে)গ্রহণ করুন।
☞ ধুলোবালি থেকে চোখ রক্ষা করুন। বাইরে বের হলে সানগ্লাস বা গগলস ব্যবহার করুন।
☞ কনট্যাক্ট লেন্সের যত্ন নিন। নিয়মিত পরিষ্কার না করলে এতে ব্যাকটেরিয়া জমে, যা জ্বালা ও সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
কখন চিকিৎসা প্রয়োজন?
যদি চোখের জ্বালার সঙ্গে নিচের উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে অবহেলা না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত
⇨ চোখ লাল হওয়া ও ব্যথা,
⇨ দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া,
⇨ অতিরিক্ত পানি পড়া বা ঘন ঘন চোখ বন্ধ হয়ে আসা,
⇨ আলো দেখলে ব্যথা অনুভব করা।
এসব উপসর্গ কর্নিয়ার সংক্রমণ, প্রদাহ বা অ্যালার্জিরও লক্ষণ হতে পারে।
চোখে জ্বালা কেবল সামান্য অস্বস্তি নয়, এটি আধুনিক জীবনের অতিরিক্ত স্ক্রিন নির্ভরতা, দূষণ ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের প্রতিফলন। আমাদের চোখ প্রতিদিন গড়ে ২০,০০০ বার পলক ফেলে, প্রতিটি পলকে তৈরি হয় নতুন অশ্রুপর্দা। এই সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হলেই চোখ তার স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা হারায়। তাই চোখের যত্ন নেওয়া মানে কেবল চোখকে বিশ্রাম দেওয়া নয়, বরং পুরো শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা, পর্যাপ্ত ঘুম, সঠিক পুষ্টি ও পরিমিত ডিজিটাল ব্যবহার নিশ্চিত করা। চোখে জ্বালা কমানোর সবচেয়ে বড় ওষুধ হলো - সচেতনতা, বিশ্রাম ও প্রাকৃতিক যত্ন। কারণ, দৃষ্টি হারানো নয়, দৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখাই আমাদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।