মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিকোণ: পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ !

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিকোণ: পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ !
ছবির ক্যাপশান, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিকোণ: পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ !
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মানুষের ব্যক্তিত্ব (Personality) তাকে আলাদা করে চেনায়। কারও আচরণে সহানুভূতি, কারও মধ্যে তীব্র আত্মবিশ্বাস, আবার কেউ সংবেদনশীল বা নিয়ন্ত্রণপ্রবণ সব মিলিয়ে মানুষ তার নিজস্ব চরিত্রে গড়ে ওঠে। কিন্তু যখন এই স্বভাবগুলো অস্বাভাবিকভাবে কঠিন, স্থায়ী এবং সম্পর্ক বা কর্মজীবনে বারবার সমস্যা তৈরি করে, তখনই সেটি রূপ নেয় পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা ব্যক্তিত্বজনিত ব্যাধিতে। এই সমস্যা খুব সহজে চোখে পড়ে না। কারণ, এটি কোনো তাৎক্ষণিক রোগ নয় বরং ব্যক্তির চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণের দীর্ঘমেয়াদি বিকৃতি। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়ই নিজেকে 'ঠিক' ভাবেন, কিন্তু আশেপাশের মানুষ তার আচরণে কষ্ট পেতে থাকে।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জিনগত প্রবণতা, শৈশবের মানসিক ট্রমা, এবং পরিবেশগত প্রভাব এই তিনটি বিষয় একত্রে মিলে ব্যক্তিত্বজনিত ব্যাধি তৈরি করতে পারে। শৈশবের সময় মস্তিষ্কের সামাজিক ও আবেগীয় অংশ (যেমন লিম্বিক সিস্টেম) গঠনাধীন থাকে। যদি সে সময় কোনো শিশু ক্রমাগত ভয়, অবহেলা, সহিংসতা বা অস্থির পরিবেশে বড় হয়, তবে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহানুভূতি বা বাস্তবতা-বোধ বিকৃত হতে পারে।
আবার, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সেরোটোনিন ও ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার-এর ভারসাম্য নষ্ট হলে মেজাজ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে, যা ব্যক্তিত্বের বিকারে ভূমিকা রাখে।

পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের ধরন-

মনোবিজ্ঞানে সাধারণত পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারকে তিনটি "ক্লাস্টারে" ভাগ করা হয়

➤ ক্লাস্টার–A: অদ্ভুত বা বিচিত্র আচরণ

☞ Paranoid Personality Disorder: অন্যদের প্রতি গভীর অবিশ্বাস ও সন্দেহপ্রবণতা।

☞ Schizoid Personality Disorder: একাকিত্বে স্বস্তি, সম্পর্কের প্রতি অনাগ্রহ।

☞ Schizotypal Personality Disorder: অদ্ভুত চিন্তা বা বিশ্বাস, বাস্তবতা থেকে দূরত্ব।

➤ ক্লাস্টার–B: নাটকীয়, আবেগপ্রবণ বা অসংযত আচরণ

⇨ Borderline Personality Disorder (BPD): অস্থির সম্পর্ক, ভয়ানক রাগ বা আত্মধ্বংসী আচরণ।

⇨ Narcissistic Personality Disorder: নিজের গুরুত্বের অতিরঞ্জন, প্রশংসার তীব্র চাহিদা।

⇨ Antisocial Personality Disorder: সামাজিক নিয়ম ভাঙা, সহানুভূতির অভাব।

⇨ Histrionic Personality Disorder: অতিরিক্ত নাটকীয়তা, মনোযোগ আকর্ষণের প্রবণতা।

➤ ক্লাস্টার–C: ভয় বা উদ্বেগপ্রবণ ব্যক্তিত্ব

⇨ Avoidant Personality Disorder: প্রত্যাখ্যানের ভয়, সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে চলা।

⇨ Dependent Personality Disorder: অন্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা।

⇨ Obsessive–Compulsive Personality ⇨ Disorder (OCPD): অতিমাত্রায় শৃঙ্খলাবদ্ধ, কঠোর চিন্তা।

মানসিক ও সামাজিক প্রভাব

এই ব্যাধিগুলো আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, পেশাগত অস্থিতিশীলতা, আত্মসম্মানহীনতা, এমনকি আত্মহননের চিন্তাও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়।
সবচেয়ে জটিল দিক হলো, আক্রান্ত ব্যক্তি সচেতন নন যে তার মধ্যে সমস্যা রয়েছে। বরং আশেপাশের মানুষই ধীরে ধীরে সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। বিশ্বব্যাপী গবেষণা বলছে, প্রায় জনসংখ্যার ৮–১০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ধরা পড়ে না, কারণ এই ব্যাধি দীর্ঘমেয়াদি এবং প্রাথমিক পর্যায়ে 'স্বভাব' বলে মনে হয়।

চিকিৎসা ও যত্ন-

পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ, কিন্তু সম্ভব। মূল ভিত্তি হলো মনোচিকিৎসা (Psychotherapy), বিশেষ করে Cognitive Behavioral Therapy (CBT), Dialectical Behavior Therapy (DBT) এবং Schema Therapy।
এই থেরাপিগুলো ধীরে ধীরে রোগীকে তার চিন্তা, আবেগ ও আচরণ বোঝার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ ব্যবহার করা হয় সহায়কভাবে, কিন্তু এককভাবে ওষুধে এ সমস্যা সারানো যায় না। চিকিৎসার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্বাস ও সহযোগিতা গড়ে তোলা। কারণ, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় চিকিৎসাকেও অস্বীকার করেন। তাই পরিবার ও বন্ধুদের বোঝাপড়াই প্রাথমিক সহায়তার জায়গা তৈরি করে।

মানুষের ব্যক্তিত্ব তার জীবনের প্রতিফলন।
কিন্তু যখন নিজের চিন্তা, আচরণ ও সম্পর্কের জটিলতা জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ কেড়ে নেয়, তখন সেটি আর কেবল 'স্বভাব' নয়, বরং এক গভীর মানসিক ব্যাধি। পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার কোনো দুর্বলতা নয়, এটি একধরনের মানসিক বৈচিত্র্য যা বোঝাপড়া, সহানুভূতি ও দীর্ঘমেয়াদি থেরাপির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অতএব, নিজের বা আশেপাশের কারও আচরণে যদি অস্বাভাবিকতা টের পাওয়া যায়, লজ্জা বা ভয় নয় বরং বোঝাপড়া ও সহমর্মিতাই হতে পারে প্রথম চিকিৎসা। কারণ, মানুষ তখনই সুস্থ হয় যখন সে নিজেকে বুঝতে শেখে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ