ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব;মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সতর্কবার্তা!

ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব;মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সতর্কবার্তা!
ছবির ক্যাপশান, ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব;মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সতর্কবার্তা!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বর্তমান যুগে আমাদের জীবন যেন স্মার্টফোনের পর্দায় সীমাবদ্ধ। ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত, দিনের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে থাকে সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, এক্স (পূর্বের টুইটার) কিংবা ইউটিউব—এই ভার্চুয়াল দুনিয়া যেমন যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, তেমনি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর ও জটিল প্রভাব ফেলছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব একদিকে সংযোগ বাড়ালেও অন্যদিকে বাড়াচ্ছে একাকিত্ব, উদ্বেগ, তুলনামূলক মানসিক চাপ ও আত্মমূল্যায়নহীনতা।

মানসিক প্রভাবের সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া: 

সোশ্যাল মিডিয়া আসলে মানুষের মস্তিষ্কের ডোপামিন সিস্টেমের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে। প্রতিটি লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার মস্তিষ্কে সাময়িক আনন্দের হরমোন ডোপামিন নিঃসৃত করে, যা আমাদের "আনন্দ পাওয়ার" কেন্দ্রকে উদ্দীপিত করে। কিন্তু এ আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী নয়। এটি 'ইনস্ট্যান্ট রিওয়ার্ড' (Instant Reward), অর্থাৎ দ্রুত আসে, দ্রুতই হারিয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্ক ক্রমে আরও বেশি লাইক বা মনোযোগের জন্য অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা এক প্রকার আসক্তিতে (Addiction) রূপ নেয়। এই অবস্থাকে বিজ্ঞানীরা বলেন "ডিজিটাল ডোপামিন লুপ" যেখানে ব্যবহারকারী অবচেতনভাবে প্রতিবার ফোন চেক করে, যেন নতুন কিছু পাওয়ার আশায়। এই চক্র থেকে বের হওয়া যত দেরি হয়, ততই মানসিক চাপ ও আত্মমূল্যায়নহীনতা বাড়ে।

তুলনা ও আত্মমূল্যায়নের সংকট

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো প্রদর্শনের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো- এই "হাইলাইট রিল" দেখেই মানুষ অন্যের জীবনকে নিজের চেয়ে ভালো মনে করতে শুরু করে। এই মানসিক অবস্থাকে বলা হয় "সোশ্যাল কম্পারিজন সিনড্রোম" (Social Comparison Syndrome)। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন দুই ঘণ্টার বেশি সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটান, তাদের মধ্যে নিজের প্রতি অসন্তুষ্টি, হীনমন্যতা ও ডিপ্রেশনের লক্ষণ বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই তুলনাজনিত মানসিক চাপ দ্রুত আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে।

নিদ্রাহীনতা ও মনোযোগহীনতা

রাতে ঘুমানোর আগে ফোন স্ক্রল করা এখন অভ্যাসে পরিণত।
কিন্তু স্মার্টফোনের স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো (Blue Light) মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন কমায়, যা ঘুম নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে দেরিতে ঘুমানো, ভোরে ক্লান্তি, মনোযোগ কমে যাওয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ঘুমের ব্যাঘাত Anxiety Disorder ও Mood Swing-এর অন্যতম কারণ হতে পারে।

 ভার্চুয়াল সংযোগ, বাস্তব একাকিত্ব

সোশ্যাল মিডিয়া মানুষকে যুক্ত করলেও সম্পর্কগুলো হয়ে পড়ছে ক্রমেই পৃষ্ঠতলীয়। ভার্চুয়াল জগতে হাজার বন্ধু থাকলেও বাস্তবে মানসিকভাবে পাশে থাকার মতো মানুষের অভাব দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি থেকে সৃষ্টি হয় "Emotional Loneliness"-এক ধরনের মানসিক শূন্যতা, যেখানে মানুষ জনসমুদ্রে থেকেও নিজেকে একা মনে করে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই একাকিত্ব দীর্ঘস্থায়ী হলে তা ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, আত্মসমালোচনার প্রবণতা এমনকি আত্মহননের চিন্তা পর্যন্ত বাড়াতে পারে।

Journal of Social and Clinical Psychology–এর এক গবেষণায় বলা হয়, যারা প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় গড়ে তিন ঘণ্টা সময় কাটান, তাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের ঝুঁকি ৩০% বেশি।  আবার, American Psychological Association জানায়, অতিরিক্ত স্ক্রলিংয়ের ফলে Attention Span (মনোযোগের সময়কাল) গড়ে ২৫% পর্যন্ত কমে যায়। British Medical Journal–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬–২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সঙ্গে উদ্বেগ, নিদ্রাহীনতা ও আত্ম-অসন্তুষ্টি সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।

সমাধান: 

মানসিক সুস্থতার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পুরোপুরি দূরে থাকা নয়, বরং সচেতনভাবে ব্যবহারের কৌশল শেখাই সবচেয়ে কার্যকর।

☞ স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন: দিনে সর্বোচ্চ ১–১.৫ ঘণ্টা ব্যবহার উপযোগী।

☞  ঘুমানোর আগে ফোন না দেখা: ঘুমের অন্তত ৩০ মিনিট আগে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন।

☞ মানবিক যোগাযোগ বাড়ান: বাস্তব জীবনে বন্ধু, পরিবার ও প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো মস্তিষ্কের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করে।

☞  ডিজিটাল ডিটক্স অভ্যাস করুন: সপ্তাহে অন্তত একদিন সোশ্যাল মিডিয়া-মুক্ত দিন পালন করুন।

সোশ্যাল মিডিয়া আজকের বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু এর অজান্তেই এটি মানুষের মনের ভেতর ঘটাচ্ছে এক নীরব বিপ্লব। সংযোগের হাতিয়ার হিসেবে এটি আশীর্বাদ, কিন্তু অতিনির্ভরতা এটিকে অভিশাপে পরিণত করছে। সুতরাং, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার নয়, বরং এর সঙ্গে মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করাই প্রকৃত সুস্থতার মূল।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ