ঘাড় ব্যথা কি কেবল ক্লান্তি? চিকিৎসকেরা বলছেন, আসল কারণ আরও ভয়ংকর!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘাড়ে টান টান ব্যথা, কাঁধ ভারী লাগা, বা হালকা মাথাব্যথা-এই উপসর্গগুলো এখন অনেকেরই নিত্যসঙ্গী। একসময় এসব ছিল বয়সজনিত সমস্যা, কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর জীবনধারায় এখন ২০–৩০ বছর বয়সী তরুণরাও আক্রান্ত হচ্ছেন "Cervical Pain" বা "Spinal Discomfort"-এ।বিশেষজ্ঞরা একে বলছেন,"Lifestyle-induced Musculoskeletal Disorder", অর্থাৎ জীবনযাত্রাজনিত মেরুদণ্ডের রোগ।
মানবদেহের মেরুদণ্ড বা স্পাইন কলাম হলো শরীরের "মূল স্তম্ভ"। এটি ৩৩টি কশেরুকা (Vertebrae) দিয়ে তৈরি, যার প্রতিটি অংশ নির্দিষ্ট কাজের জন্য দায়ী।ওপরের সাতটি কশেরুকা (C1–C7) গঠন করে Cervical Spine, অর্থাৎ ঘাড়ের হাড়।মাঝের ১২টি অংশ Thoracic Spine, যা বুকের সঙ্গে যুক্ত।নিচের পাঁচটি হলো Lumbar Spine, অর্থাৎ কোমরের হাড়।এই হাড়গুলির মাঝে থাকে জেলির মতো নরম উপাদান যা ধাক্কা শোষণ করে এবং হাড়গুলির মধ্যে ভারসাম্য রাখে, যাকে বলে intervertebral discs।কিন্তু দীর্ঘক্ষণ এক ভঙ্গিতে বসে থাকা বা ভুলভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করলে এই ডিস্কগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা, পেশি টান বা ডিস্ক স্লিপের মতো সমস্যায় রূপ নেয়।
বিশ্বব্যাপী এখন যে নতুন শব্দটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা হলো "Tech Neck Syndrome"।যখন কেউ দিনে কয়েক ঘণ্টা মোবাইল বা ল্যাপটপের দিকে নিচু হয়ে তাকিয়ে থাকে, তখন ঘাড়ের ওপর বাড়তি ভার তৈরি হয়।মানুষের মাথার ওজন গড়ে ৪.৫ থেকে ৫.৫ কেজি পর্যন্ত। কিন্তু যদি কেউ ৪৫ ডিগ্রি কোণে মাথা নিচু করে স্ক্রিনের দিকে তাকায়, তখন সেই ওজন ঘাড়ের পেশিতে প্রায় ২৫ কেজি সমান চাপ সৃষ্টি করে। এই অস্বাভাবিক চাপ ঘাড়ের পেশি, স্নায়ু এবং ডিস্কে ধীরে ধীরে ক্ষতি ঘটায়।ফলে দেখা দেয় স্থায়ী ব্যথা, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, এমনকি কাঁধ ও বাহু পর্যন্ত ব্যথা ছড়িয়ে পড়া।
লক্ষণ: উপেক্ষা করলেই বড় বিপদ!
প্রাথমিকভাবে অনেকেই ব্যথাকে গুরুত্ব দেন না, ভাবেন ঘুমের ভঙ্গি বা সামান্য ক্লান্তির কারণে হয়েছে।কিন্তু এর পেছনে থাকতে পারে ঘাড়ের হাড়ের ক্ষয় (Cervical Spondylosis) বা ডিস্কের স্থানচ্যুতি।
সাধারণ উপসর্গগুলো হলো:
☞ ঘাড়ে টান বা ব্যথা, বিশেষত সকালে ঘুম থেকে উঠলে।
☞ মাথা ঘোরা বা ভারী লাগা।
☞ কাঁধ ও বাহু পর্যন্ত ব্যথা বা অবশ ভাব।
☞ আঙুলে ঝিনঝিন অনুভূতি বা দুর্বলতা।
☞ দীর্ঘসময় বসে কাজ করার পর পিঠ ভারী লাগা।
চিকিৎসকরা সতর্ক করছেন, অবহেলা করলে এই ব্যথা মেরুদণ্ডের স্নায়ুতে স্থায়ী ক্ষতি করে দিতে পারে, যা পরবর্তীতে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত গড়াতে পারে।
মেরুদণ্ডের প্রতিটি ডিস্ক এক ধরনের "শক অ্যাবজর্ভার" হিসেবে কাজ করে। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা অবস্থায় যখন শরীর নড়াচড়া করে না, তখন ডিস্কে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। এতে পুষ্টি সরবরাহ বন্ধ হয়ে কোষের ক্ষয় শুরু হয়। ফলে ডিস্কের অভ্যন্তরস্থ জেলির মতো উপাদান শুকিয়ে যায় ও ফেটে যেতে পারে, যাকে বলে "Herniated Disc"। এ সময় ওই স্থানে প্রদাহ হয়, যা স্নায়ু শিকড়ে চাপ ফেলে ব্যথা ও অবশতা তৈরি করে।বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, ভুল অঙ্গবিন্যাসে বসলে মেরুদণ্ডে প্রতি ইঞ্চি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫০–২০০ নিউটন অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদে মাংসপেশির টিস্যু নষ্ট করে দেয়।
প্রতিরোধ: জীবনযাত্রার পরিবর্তনই মূল সমাধান!
১. সঠিক বসার ভঙ্গি: চেয়ার এমন হতে হবে যাতে পিঠ সোজা থাকে এবং কোমর চেয়ারের ব্যাক সাপোর্টে ঠেকে থাকে। মনিটর চোখের সমান্তরালে রাখলে ঘাড়ের ওপর চাপ কমে।
২. প্রতি আধঘণ্টায় নড়াচড়া:একটানা বসে কাজ না করে প্রতি ৩০–৪০ মিনিট পর উঠে দাঁড়ানো, কিছুটা হাঁটা বা হালকা স্ট্রেচিং করলে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পায়।
৩. ঘাড়ের স্ট্রেচ ও ব্যায়াম: ধীরে ধীরে ঘাড় ডান-বামে ঘোরানো, কাঁধ উঁচু-নিচু করা, সামান্য পেছনে টেনে সোজা ভঙ্গিতে রাখা—এই সহজ ব্যায়ামগুলো ঘাড়ের পেশিকে নমনীয় রাখে।
৪. পর্যাপ্ত ঘুম ও ভঙ্গি ঠিক রাখা: অতিরিক্ত শক্ত বা উঁচু বালিশ ব্যবহার করা উচিত নয়। ঘুমানোর সময় মেরুদণ্ড যেন স্বাভাবিক রেখায় থাকে, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।
৫. মোবাইল ব্যবহারে সচেতনতা: ফোন স্ক্রল করার সময় স্ক্রিন চোখের সমান্তরালে তোলার অভ্যাস করুন, মাথা নিচু করে না।
চিকিৎসার পদ্ধতি ও আধুনিক গবেষণা-
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যথা কমাতে গরম সেঁক, বিশ্রাম, অথবা মাংসপেশি শিথিলকারী ফিজিওথেরাপি সবচেয়ে কার্যকর। আধুনিক চিকিৎসায় "Posture Correction Therapy", "Ultrasound Therapy" এবং "Dry Needling"–এর মতো পদ্ধতিগুলোও ব্যবহার করা হচ্ছে পেশি পুনর্গঠনের জন্য।গবেষণা বলছে, মাইন্ডফুল ব্রিদিং বা সচেতন শ্বাসপ্রশ্বাসের অনুশীলন ঘাড়ের টান কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। কারণ এটি স্নায়ু প্রশমিত করে এবং মাংসপেশির সংকোচন হ্রাস করে।
ঘাড় ও মেরুদণ্ড শুধু দেহের হাড় নয়, এটি শরীরের ভারসাম্য ও স্নায়ুতন্ত্রের মূল সেতুবন্ধন।আমরা যদি প্রতিদিন সামান্য সচেতনতা বজায় রাখি। সঠিক ভঙ্গিতে বসা, মাঝে মাঝে নড়াচড়া, এবং ডিজিটাল স্ক্রিনে সময় সীমিত করা, তাহলে এই 'নীরব বিপদ' থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। অতএব, ব্যথা শুরু হওয়ার আগেই সতর্ক হোন। কারণ মেরুদণ্ড একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি আর আগের মতো হয় না।সচেতন জীবনই হতে পারে মেরুদণ্ডের সুরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।