চুল পড়া থেকে শীতল মাথা,এক মুঠোতেই প্রকৃতির নিঃশব্দ চিকিৎসা!

চুল পড়া থেকে শীতল মাথা,এক মুঠোতেই প্রকৃতির নিঃশব্দ চিকিৎসা!
ছবির ক্যাপশান, চুল পড়া থেকে শীতল মাথা,এক মুঠোতেই প্রকৃতির নিঃশব্দ চিকিৎসা!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

প্রতিদিন সকালে চুলের চিরুনি হাতে নিয়ে অনেকেই অবাক হয়ে যান,এত চুল ঝরে কেন? হরমোনের ভারসাম্য, দূষণ, মানসিক চাপ, এমনকি ভুল খাদ্যাভ্যাস- সবকিছুর প্রভাব পড়ে চুলের বৃদ্ধির ওপর। এই সময়েই এক প্রাচীন উপাদান আবার নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে আর তা হলো -মেথি দানা (Fenugreek Seeds)।ভারতীয় উপমহাদেশে যুগের পর যুগ ধরে এটি শুধু রান্নার স্বাদ বাড়ানোর মসলা নয়, বরং মাথার ত্বক ও চুলের যত্নে প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।বর্তমানে আধুনিক ট্রাইকোলজি (চুলবিজ্ঞান) গবেষণায়ও মেথির রাসায়নিক উপাদানকে বলা হচ্ছে:"Natural Hair Growth Activator"।

মেথি দানা মূলত Trigonella foenum-graecum উদ্ভিদের শুকনো বীজ, যা শত শত ক্ষুদ্র জৈব যৌগে সমৃদ্ধ।এর প্রধান সক্রিয় উপাদানগুলো হলো

⇨ Diosgenin: উদ্ভিজ্জ স্টেরয়েড, যা কোষ বিভাজন ও পুনর্জন্ম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।

⇨ Lecithin: একধরনের প্রাকৃতিক ইমালসিফায়ার, যা চুলের গোড়ায় আর্দ্রতা ধরে রাখে ও পুষ্টি সরবরাহ করে।

⇨ Saponins ও Alkaloids: যেগুলো মাথার ত্বকের রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, প্রদাহ কমায় এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

⇨ Iron, Magnesium, Vitamin B2, B3, ও C: এগুলো চুলের ফলিকল (Hair Follicle) পুষ্ট রাখতে অপরিহার্য।

এই রাসায়নিক উপাদানগুলো একসঙ্গে কাজ করে চুলের কোষের বৃদ্ধির "Anagen Phase" দীর্ঘায়িত করে এবং "Telogen Phase" অর্থাৎ ঝরে পড়ার সময়কাল বিলম্বিত করে। এতে চুল পড়ে কম, গজায় বেশি।

মানুষের মাথার প্রতি চুলের ফলিকল তিনটি পর্যায়ে কাজ করে

১️। Anagen (বৃদ্ধির সময়কাল)

২️। Catagen (অন্তর্বর্তী পর্যায়)

৩️। Telogen (বিশ্রাম ও ঝরার সময়)

অতিরিক্ত স্ট্রেস, হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা (বিশেষত DHT হরমোনের বৃদ্ধি), কিংবা পুষ্টির অভাবে এই চক্র দ্রুত শেষ হয়ে যায়, ফলে চুল অকালেই পড়ে যায়।

মেথির Diosgenin ও Phytoestrogen যৌগ DHT উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে, যা চুল পড়া কমায় এবং নতুন চুল গজানোর সংকেত দেয় ফলিকলকে।এছাড়া Lecithin মাথার ত্বকের মৃত কোষ সরিয়ে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়, ফলে পুষ্টি উপাদান দ্রুত পৌঁছে যায় গোড়ায়।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে মাথার ত্বকে অতিরিক্ত ঘাম, তেল এবং ব্যাকটেরিয়া জমে ফাঙ্গাল সংক্রমণ হয়।ফলে চুলকানি, খুশকি ও চুল পড়া বাড়ে।মেথিতে থাকা mucilage compound মাথার ত্বকে একধরনের প্রাকৃতিক জেলি তৈরি করে, যা ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স বজায় রাখে এবং শীতলতা দেয়।

বৈজ্ঞানিকভাবে দেখা গেছে, মেথি মাথার ত্বকের "sebaceous gland"-এর তেলের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে। যাদের মাথা বেশি তৈলাক্ত বা ঘামে ভিজে থাকে, তাদের জন্য এটি প্রাকৃতিক "seboregulator" হিসেবে কাজ করে।ফলে মাথার ত্বক থাকে ঠান্ডা, প্রদাহমুক্ত এবং চুলের গোড়া থাকে পরিষ্কার,যা নতুন চুল গজানোর পরিবেশ তৈরি করে।

 ব্যবহার: 

১. ভেজানো মেথির পেস্ট-

এক কাপ মেথি দানা ৮–১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে মিহি করে পেস্ট তৈরি করুন।এই পেস্ট চুলের গোড়া ও মাথার ত্বকে লাগিয়ে ৩০–৪৫ মিনিট রেখে কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে এটি প্রাকৃতিক হেয়ার মাস্কের মতো কাজ করে।এটি চুলে প্রোটিন যোগায়, ফলিকল শক্ত করে এবং মাথার ত্বকে ঠান্ডা ভাব আনে।

২. মেথি তেল (Infused Oil)-

নারিকেল বা তিলের তেলে মেথি দানা হালকা গরম করে এক সপ্তাহ রেখে দিলে তেলের সঙ্গে মেথির সক্রিয় উপাদান মিশে যায়। এই তেল সপ্তাহে দুইবার ব্যবহার করলে রক্তসঞ্চালন বাড়ে, চুলের গোড়া শক্ত হয় ও মাথার ক্লান্তি কমে।

৩. মেথি ও দইয়ের মিশ্রণ-

শুষ্ক বা রুক্ষ চুলের জন্য মেথি পেস্টের সঙ্গে দই মিশিয়ে লাগানো সবচেয়ে উপকারী। দইয়ের ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বক পরিষ্কার করে, আর মেথি পুষ্টি ও ঠান্ডা ভাব দেয়। এই মিশ্রণ গরমে মাথার অতিরিক্ত তাপ কমাতে সাহায্য করে।

৪. মেথি চা বা ইনফিউশন-

মেথির ভেতরের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ভেতর থেকেও উপকার করে। প্রতিদিন সকালে মেথি ভেজানো পানি পান করলে রক্তে ইনসুলিন ও হরমোন ভারসাম্য রক্ষা পায়, যা পরোক্ষভাবে চুলের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।

২০১৫ সালে "Journal of Cosmetic Dermatology"-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে-৮ সপ্তাহ ধরে মেথি এক্সট্র্যাক্টযুক্ত সিরাম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৮২% অংশগ্রহণকারীর চুল পড়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং ৬৩% ক্ষেত্রে নতুন চুল গজানোর প্রমাণ মিলেছে।আরেকটি পরীক্ষায়, প্রাণীদেহে মেথি নির্যাস প্রয়োগে চুলের "growth phase" গড়ে ৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

মেথির "anti-inflammatory" গুণ মাথার প্রদাহ কমায়, আর "antimicrobial" গুণ স্কাল্পে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে দেয় না,যা চুলের গোড়া রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

চুলের যত্নে মেথির ব্যবহার নিয়মিত হতে হবে।এটি তাত্ক্ষণিক ফল দেয় না, বরং কোষগত পর্যায়ে কাজ করে।প্রথম কয়েক সপ্তাহে মাথার ত্বক পরিষ্কার ও ঠান্ডা লাগবে, এরপর ধীরে ধীরে চুল পড়া কমে ও নতুন চুল গজাবে।যাদের মাথার ত্বক অতিসংবেদনশীল, তাঁদের জন্য প্রথমে ছোট অংশে পরীক্ষা করে দেখা উচিত।সর্বোপরি, খাদ্যাভ্যাসে প্রোটিন, আয়রন ও পানি পর্যাপ্ত রাখতে হবে, কারণ চুলের পুষ্টি আসে শরীরের ভেতর থেকেই।

মেথি দানা হলো প্রকৃতির তৈরি এক নিঃশব্দ বিজ্ঞান, যেখানে প্রতিটি উপাদান শরীরের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে।চুলে এর প্রভাব শুধু বাহ্যিক নয়; এটি কোষের স্তরে গিয়ে কাজ করে, রক্তসঞ্চালন বাড়ায় এবং ত্বকের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।আজ যখন কেমিক্যাল-নির্ভর প্রোডাক্টে চুল ক্ষয়ে যাচ্ছে, তখন প্রাচীন ভেষজ বিজ্ঞানের এই উপহারই হতে পারে স্থায়ী সমাধান।প্রকৃতি যেমন নিঃশব্দে কাজ করে, তেমনি মেথি দানাও নিঃশব্দে ফিরিয়ে দেয় প্রাণবন্ত চুল ও শীতল মাথার স্বস্তি।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ