মানুষ কেন দিন দিন কম মায়াময় হচ্ছে? সূত্র জানাচ্ছে-কিসের অভাব!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ডিজিটাল স্ক্রিনের যুগে আমরা যত বেশি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট পড়ছি, ততই যেন কমে যাচ্ছে মানুষের প্রতি অনুভূতির গভীরতা। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, বই পড়া শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি মানুষের সহমর্মিতা (Empathy), আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (Emotional Intelligence) ও সামাজিক আচরণের ভারসাম্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাঠাভ্যাস কমে গেলে আমাদের মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল, বিশেষ করে যেগুলো অন্যের অনুভূতি বোঝা ও কল্পনার জগৎ তৈরি করে, সেগুলোর কার্যকারিতাও ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায়।
বই পড়া একটি জটিল নিউরোকগনিটিভ প্রক্রিয়া। যখন আমরা কোনো উপন্যাস বা আত্মজীবনী পড়ি, তখন মস্তিষ্কের temporal lobe (ভাষা প্রক্রিয়াকরণ), prefrontal cortex (নৈতিক ও আবেগীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ) এবং parietal lobe (অনুভূতি ও স্থান-চেতনা) একসাথে সক্রিয় হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কেউ গল্পের চরিত্রের আবেগ ও চিন্তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে, তখন mirror neurons সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই নিউরনগুলোই অন্যের অনুভূতি উপলব্ধি করতে সাহায্য করে, অর্থাৎ সহমর্মিতা গড়ে তোলে।ফলে, নিয়মিত বই পড়া মানুষরা অন্যের দুঃখে কষ্ট পায়, অন্যের আনন্দে খুশি হয়। অর্থাৎ তারা আবেগগতভাবে বেশি সংবেদনশীল। বিপরীতে, শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্টে অভ্যস্ত মানুষদের মধ্যে এই সংবেদনশীলতা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যায়।
ডিজিটাল কনটেন্টে মস্তিষ্ক সাধারণত দ্রুত তথ্য প্রক্রিয়া করে।এখানে মনোযোগের স্থায়িত্ব কম, আর কল্পনার ক্ষেত্রও সীমিত।অন্যদিকে, বই পড়ার সময় মস্তিষ্ক তথ্যকে ধীরগতিতে বিশ্লেষণ করে, কল্পনার জায়গা তৈরি করে এবং চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে।নিউরোসায়েন্টিস্টদের মতে, এই ধীর এবং মনোযোগী পাঠ প্রক্রিয়া মস্তিষ্কে "Deep Reading Network" গঠন করে,যা সহমর্মিতা, আত্ম-চিন্তা ও নৈতিক উপলব্ধি বাড়ায়।অর্থাৎ, বই পড়া মানে কেবল জ্ঞান আহরণ নয়, বরং এটি এক ধরনের মানবিক অনুশীলন, যা আমাদের মস্তিষ্ককে সহানুভূতিশীল রাখে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিক্ষার্থী বা প্রাপ্তবয়স্ক নিয়মিত গল্প, সাহিত্য বা জীবনীমূলক লেখা পড়েন, তারা বাস্তব জীবনে অন্যের দুঃখ বুঝতে ও সাহায্য করতে বেশি আগ্রহী হন।
অন্যদিকে, যারা শুধুমাত্র অনলাইন পোস্ট বা সংক্ষিপ্ত ভিডিও দেখেন, তাদের মধ্যে সহমর্মিতা ও ধৈর্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
একটি পরীক্ষায়, অংশগ্রহণকারীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। একদল পড়েছিল ক্লাসিক উপন্যাস, অন্যদল পড়েছিল সংক্ষিপ্ত সংবাদ বা তথ্যভিত্তিক লেখা। পরীক্ষার পর দেখা গেল, উপন্যাস পড়া দলটি অন্যের মুখের অভিব্যক্তি ও অনুভূতি বোঝার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সক্ষম ছিল।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের আবেগগত বিকাশ মূলত কল্পনা ও প্রতিফলনের ওপর নির্ভরশীল। সাহিত্য, গল্প বা আত্মজীবনী আমাদেরকে অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে শেখায়, যাকে বলা হয় "Perspective Taking"।এই ক্ষমতাই সহমর্মিতার ভিত্তি। বই পড়া বন্ধ হলে সেই কল্পনাশক্তি সংকুচিত হয়, মানুষ হয়ে ওঠে তথ্যনির্ভর কিন্তু অনুভূতিহীন।
আজকের তরুণ প্রজন্ম দ্রুত তথ্য গ্রহণে পারদর্শী হলেও, তাদের আবেগীয় গভীরতা ও সংযোগ তৈরির ক্ষমতা কমছে। সমাজবিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, যদি পাঠাভ্যাস আরও কমে যায়, তবে ভবিষ্যতে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও মানবিক সম্পর্কের বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজই হয়ে উঠবে এক ধরনের "emotionally disconnected civilization", যেখানে জ্ঞান থাকবে, কিন্তু মমতা হারিয়ে যাবে।
করণীয়:
১. প্রতিদিন অন্তত ২০–৩০ মিনিট বই পড়ার অভ্যাস করুন, বিশেষ করে গল্প বা আত্মজীবনী।
২. ঘুমের আগে স্ক্রিন বাদ দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা খুলুন, মস্তিষ্ক তখন তথ্য গ্রহণে সবচেয়ে সক্রিয় থাকে।
৩. সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই গল্প শোনান, যেন তারা শব্দের মাধ্যমে আবেগ শিখতে পারে।
৪. অফিস বা স্কুলে "Reading Hour" চালু করা গেলে সেটি সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে কার্যকর হবে।
মানুষকে মানুষ বানায় তার অনুভূতি, যুক্তি নয়। আর সেই অনুভূতির উষ্ণতা টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে প্রাকৃতিক উপায় হলো বই পড়া।স্ক্রিন যতই চকচকে হোক, মুদ্রিত অক্ষরের মধ্যে যে মানবিক আলো, সেটিই মস্তিষ্কে জ্বেলে রাখে সহমর্মিতার প্রদীপ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।