শহরের ভবন কি সত্যিই নিজেই বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারবে?নতুন বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ইঙ্গিত!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দূষণ, জ্বালানি সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে বিজ্ঞানীরা এখন এমন এক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন, যা ভবিষ্যতের শহরগুলোকে বদলে দিতে পারে সম্পূর্ণভাবে 'স্মার্ট কংক্রিট' (Smart Concrete)।এই বিশেষ ধরণের নির্মাণ উপাদান শুধু ভবন বা রাস্তা তৈরি করবেই না, বরং নিজেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারবে।অর্থাৎ ভবিষ্যতের ঘরবাড়ি, সেতু, এমনকি ফুটপাথও হতে পারে ক্ষুদ্র শক্তি কেন্দ্র!
কী এই স্মার্ট কংক্রিট?
প্রচলিত কংক্রিট তৈরি হয় সিমেন্ট, বালি, পানি ও পাথরের মিশ্রণে। কিন্তু স্মার্ট কংক্রিটে যুক্ত করা হয় কার্বন ন্যানোটিউব (Carbon Nanotubes), গ্রাফিন (Graphene) বা কার্বন ব্ল্যাক (Carbon Black), যেগুলো বিদ্যুৎ পরিবাহী উপাদান। এই উপাদানগুলো কংক্রিটের ভেতর ছড়িয়ে দিলে এর ভেতরে তৈরি হয় এক ধরনের 'conductive network', যা বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সঞ্চয় করতে সক্ষম।ফলে একটি ভবন নিজের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শক্তি উৎপাদন করতে পারে, যেমনভাবে ব্যাটারি চার্জ হয় বা সৌরপ্যানেল সূর্যের আলো থেকে শক্তি নেয়।
স্মার্ট কংক্রিট কাজ করে মূলত দুটি প্রক্রিয়ায়
১। Piezoelectric Effect (চাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন)
২। Capacitive Energy Storage (শক্তি সঞ্চয়)
যখন কেউ হাঁটে, গাড়ি চলে, কিংবা ভবনে বাতাস বা কম্পন সৃষ্টি হয়, তখন সেই যান্ত্রিক চাপ কংক্রিটের ভেতরের উপাদানগুলোর ওপর পড়ে এবং তা থেকে তৈরি হয় ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক চার্জ। এই চার্জ কংক্রিটে সঞ্চিত হয়ে ভবনের লাইট, সেন্সর বা ছোট ইলেকট্রনিক ডিভাইস চালাতে ব্যবহার করা যেতে পারে।অর্থাৎ, মানুষের পদচারণা, বাতাসের দোলন, কিংবা গাড়ির চাকার চাপ- সবই হতে পারে শক্তির উৎস!
ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ডেনমার্ক ও ইতালির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মার্ট কংক্রিটের ওপর গবেষণা চলছে।বিশেষ করে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT) ও ডেলফট ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি-এর গবেষকরা সফলভাবে এমন কংক্রিট তৈরি করেছেন, যা ছোট ব্যাটারির মতো বিদ্যুৎ সঞ্চয় করতে পারে।
প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক বর্গমিটার স্মার্ট কংক্রিট প্রায় ১০–২০ ওয়াট ঘণ্টা (Wh) শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম। এটি হয়তো একটি ছোট বাতি বা সেন্সর চালাতে যথেষ্ট, তবে ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি উন্নত হলে পুরো ভবন বা সড়ক আলোকায়নে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
সম্ভাবনা:
ভাবুন, একটি শহরের প্রতিটি সেতু, রাস্তা বা ভবন নিজে থেকেই শক্তি তৈরি করছে। তাহলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা অনেক কমে যাবে।স্মার্ট কংক্রিট ব্যবহার করলে:
⇨ ভবনের সেন্সর ও আলোকব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে।
⇨ রাস্তায় এমবেড করা সেন্সর ট্রাফিক ও তাপমাত্রা পরিমাপ করতে পারবে নিজস্ব শক্তিতে।
⇨ সেতুর ভেতরের সেন্সর কোনো ফাটল বা চাপ শনাক্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কবার্তা পাঠাতে পারবে।
এভাবে স্মার্ট কংক্রিট শহরকে শুধু টেকসই নয়, বরং বুদ্ধিমান (intelligent infrastructure) হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
প্রচলিত কংক্রিট বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত নির্মাণ উপাদান, কিন্তু এটি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের অন্যতম বড় উৎস।স্মার্ট কংক্রিট যদি একইসঙ্গে শক্তি উৎপাদনের দায়িত্ব নেয়, তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্প উৎস হিসেবে এটি পরিবেশ দূষণ কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এমনকি ভবিষ্যতে সৌরপ্যানেল ও স্মার্ট কংক্রিট একসাথে ব্যবহার করে "energy-positive buildings" তৈরি করা সম্ভব, যেগুলো নিজেদের ব্যবহার করা শক্তির চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা-
তবে বাস্তব প্রয়োগে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:এই কংক্রিট তৈরির খরচ এখনো তুলনামূলক বেশি। বিদ্যুৎ সঞ্চয়ক্ষমতা এখনো সীমিত পর্যায়ে। বড় আকারে স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রযুক্তি এখনো গবেষণাধীন। তবুও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রযুক্তি যত উন্নত হবে, ততই উৎপাদন খরচ কমবে এবং এটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য হবে।
বিজ্ঞানীরা এখন এমন স্মার্ট কংক্রিটের মডেল তৈরির চেষ্টা করছেন যা সৌরশক্তি, তাপ ও কম্পন-সব ধরনের শক্তি একসাথে রূপান্তর করতে পারবে।
এমন ভবিষ্যতে, শহরের ভবনগুলো কেবল আশ্রয়স্থল নয়, বরং হয়ে উঠবে "self-powering ecosystems", নিজের প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণে সক্ষম স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থাপনা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।