মানব সভ্যতার হারানো জ্ঞানভাণ্ডার, যা ইতিহাসের ধোঁয়ায় বিলীন হয়ে গেলেও আলো ছড়িয়ে যায় আজও!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
প্রাচীন মিসরের উত্তর উপকূলে গড়ে উঠেছিল আলেকজান্দ্রিয়া,একটি শহর যা বিশ্বের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতকে এটি ছিল বাণিজ্য, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলার মিলনস্থল।তবে আলেকজান্দ্রিয়ার মহাগ্রন্থাগার-The Great Library of Alexandria-ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যেখানে মানব সভ্যতার জ্ঞান সঞ্চিত ছিল একত্রিতভাবে। ইতিহাসবিদরা একমত যে, গ্রন্থাগারের ধ্বংস মানব সভ্যতার এক অমূল্য ক্ষতি, কারণ এখানে ছিল প্রাচীন বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও সাহিত্যকর্মের সংকলন, যা আমাদের আধুনিক জ্ঞানচর্চার ভিত্তি স্থাপন করত।
আলেকজান্দার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর, মিসরে ক্ষমতা স্থাপন করেন তাঁর সেনাপতি পটলেমি প্রথম সোটার (Ptolemy I Soter)। তিনি ও তাঁর উত্তরসূরি পটলেমি দ্বিতীয় (Ptolemy II Philadelphus) আলেকজান্দ্রিয়াকে পরিণত করেন জ্ঞান ও শিক্ষার কেন্দ্র। গ্রন্থাগারটি ছিল Mouseion কমপ্লেক্সের অংশ, যা শুধু বইয়ের জন্য নয়, গবেষণা, শিক্ষাদীক্ষা ও আবিষ্কারের জন্যও তৈরি করা হয়েছিল।Mouseion মানে Muses'এর স্থান,যাদেরকে গ্রিক মিথে শিল্প ও বিজ্ঞানের দেবী হিসেবে মানা হত।এখানে বসবাস করতেন বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পণ্ডিতরা, যাদের গবেষণার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানচর্চা সমৃদ্ধ হতো।গবেষকরা অনুমান করেন, গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপি সংখ্যা ছিল ৪ লাখ থেকে ৭ লাখ।এগুলো ছিল হস্তলিখিত স্ক্রল, মূলত প্যাপিরাসে লেখা।
সংরক্ষিত বিষয়বস্তু:
◑ বিজ্ঞান: জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন
◑ চিকিৎসা: প্রাচীন হিপোক্রেটিস, গ্রীক ও মিশরীয় চিকিৎসাপদ্ধতি
◑ সাহিত্য ও দর্শন: হোমার, অ্যারিস্টটল, প্লেটো, ও ভারতীয় দার্শনিক লেখা অনুবাদ
◑ ভূগোল ও ইতিহাস: মিশর, পারস্য, ভারত ও ব্যাবিলনের ভূগোল ও ইতিহাস
নতুন বই ও স্ক্রল আসত এমনভাবে,যে কোনো বন্দরনগরী থেকে বই বা স্ক্রল আনা হতো গ্রন্থাগারে।প্রথমে পণ্ডিতেরা কপিগুলো করে মূল মালিককে ফেরত দিতেন।মূল কপি সংরক্ষণ করা হতো,এই প্রক্রিয়ায় আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে উঠেছিল বিশ্বের প্রথম কেন্দ্রীভূত তথ্যভাণ্ডার।
গ্রন্থাগারটি শুধুই বইয়ের গুদাম নয়, এটি ছিল একটি জীবন্ত গবেষণা কেন্দ্র। ইউক্লিড (Euclid) লিখেছিলেন Elements,যা আজও জ্যামিতির ভিত্তি।এরাটোসথেনিস (Eratosthenes) প্রথমবার পৃথিবীর পরিধি সঠিকভাবে গণনা করেন।
হেরোফিলাস (Herophilus) মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে প্রাথমিক গবেষণা করেন। আর্কিমিডিস (Archimedes) পদার্থবিজ্ঞান ও তরলপদার্থের সূত্র উদ্ভাবন করেন।এখানে বসেই তৈরি হয়েছিল প্রথম মানক জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও চিকিৎসা ধারণা, যা আধুনিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসার মূল ভিত্তি।
ধ্বংসের ইতিহাস: মানব সভ্যতার এক অমূল্য ক্ষতি!
আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের ধ্বংস একবারে হয়নি, বরং তা ধাপে ধাপে হয়।
➤ খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮: রোমান জেনারেল জুলিয়াস সিজার যখন মিসরে অভিযান চালান, বন্দরের আশেপাশে আগুন লাগে।
এতে হাজার হাজার স্ক্রল পুড়ে যায়।
➤ খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতক:ধর্মীয় সংঘর্ষের সময় Serapeum Library ধ্বংস হয়।
➤ খ্রিষ্টীয় ৬৪২:মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনে আস যখন আলেকজান্দ্রিয়া দখল করেন, অবশিষ্ট স্ক্রল ধ্বংস হয় বলে ধারণা। ধ্বংসের ফলে শুধু ভবন নষ্ট হয়নি, মানব সভ্যতার হাজার বছরের জ্ঞানচর্চার ইতিহাস হারিয়ে গেছে।
হারানোর প্রভাব: সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা!
গ্রন্থাগারের ধ্বংসে মানবজাতি হারায়
⇨ অগণিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কার
⇨ বিভিন্ন সভ্যতার দর্শন ও সাহিত্য
⇨ প্রাচীন প্রযুক্তি ও গণিতের অমূল্য নথি
গবেষকরা বলেন,
"The Library's destruction created a knowledge gap of nearly a millennium."
অর্থাৎ, রেনেসাঁ বা বৈজ্ঞানিক বিপ্লব অনেক আগে ঘটতে পারত।
আধুনিক পুনর্জন্ম: Bibliotheca আলেক্সান্দ্রিনা!
২০০২ সালে নির্মিত Bibliotheca Alexandrina আধুনিক প্রযুক্তি, গবেষণা ও শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়ার ঐতিহ্য বহন করে।এখানে রয়েছে—
⇨ ৮ মিলিয়নেরও বেশি বই
⇨ ডিজিটাল আর্কাইভ
⇨ আন্তর্জাতিক গবেষণা ও সম্মেলন কেন্দ্র
⇨ জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভাষা ও বিজ্ঞান গবেষণার ল্যাব
স্থাপত্য প্রতীকী-গোলাকার সূর্য রূপের ভবন, যার দেয়ালে খোদাই করা আছে পৃথিবীর সব ভাষার অক্ষর।
আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার পুড়ে গেলেও, এর আলোর ছাপ আজও টিকে আছে। প্রতি লাইব্রেরি, প্রতিটি গবেষণাগার, প্রতিটি শিক্ষার্থীরা বহন করছে সেই জ্ঞানের দীপ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।