মনের অস্থিরতা দূর করার নতুন উপায়,বিশ্বজুড়ে আলোচিত DBT থেরাপি!

মনের অস্থিরতা দূর করার নতুন উপায়,বিশ্বজুড়ে আলোচিত DBT থেরাপি!
ছবির ক্যাপশান, মনের অস্থিরতা দূর করার নতুন উপায়,বিশ্বজুড়ে আলোচিত DBT থেরাপি!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আধুনিক জীবনের চাপ, অনিশ্চয়তা ও সম্পর্কের টানাপোড়েনে মানুষ ক্রমেই মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। কেউ নিজের আবেগ সামলাতে পারছে না, কেউ আবার অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দিয়ে সম্পর্ক ভাঙছে, আত্মসম্মান হারাচ্ছে। এমন সময়, মনোবিজ্ঞানের এক আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক থেরাপি-ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি (Dialectical Behavior Therapy-DBT) হয়ে উঠেছে মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার এক শক্তিশালী উপায়। এটি শুধু কোনো থেরাপি নয়; বরং একধরনের মননশীল জীবনদর্শন, যা মানুষকে শেখায় কীভাবে নিজের রাগ, ভয়, দুঃখ বা অস্থিরতাকে স্বীকার করে, সেটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাঁচতে হয়।

DBT কী, এক নজরে বোঝা যাক!

DBT শব্দটি এসেছে দুটি অংশ থেকে
"Dialectical" মানে হলো বিপরীতের মধ্যে সামঞ্জস্য খোঁজা (যেমন: "গ্রহণ করা" এবং "পরিবর্তন আনা" একসঙ্গে শেখা)।
আর "Behavior Therapy" মানে হলো আচরণগত থেরাপি, যা আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে। এই থেরাপির মূল দর্শন: "মানুষ যেমন, তাকে সেইভাবে গ্রহণ করা; একই সঙ্গে তাকে উন্নতির পথে সাহায্য করা।"

এটি তৈরি করেন মার্কিন মনোবিজ্ঞানী মার্শা লিনেহান, যিনি নিজেই মানসিক যন্ত্রণার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল এমন একটি থেরাপি তৈরি করা যা মানুষকে নিজেকে দমন না করে, বরং বোঝার ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল শেখাবে।

কীভাবে DBT কাজ করে?

DBT মস্তিষ্ক ও আচরণের সংযোগকে লক্ষ্য করে কাজ করে। এটি চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে গঠিত-

১️। Mindfulness (মননশীলতা):বর্তমান মুহূর্তে থাকা ও নিজের চিন্তা–অনুভূতি–প্রতিক্রিয়াকে নিরপেক্ষভাবে দেখা। এটি শেখায়: "আমি এখন কী অনুভব করছি?" – না যে "আমি এই অনুভূতিতে হারিয়ে যাচ্ছি।"

২️। Distress Tolerance (বেদনা সহ্য করার ক্ষমতা):চরম আবেগ বা কষ্টের মুহূর্তে আত্মবিধ্বংসী আচরণ না করে সেই অবস্থাকে সহ্য করা ও সামলানো।এটি শেখায় কষ্ট মেনে নেওয়া, না যে কষ্ট এড়িয়ে যাওয়া।

৩️। Emotion Regulation (আবেগ নিয়ন্ত্রণ):নিজের আবেগকে বোঝা, বিশ্লেষণ করা ও প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণে আনা। উদাহরণ: "আমি রাগ হয়েছি, কিন্তু আমি সেটা প্রকাশ করার আগে ভাবব।"

৪️। Interpersonal Effectiveness (সম্পর্কে দক্ষতা):অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে নিজের প্রয়োজন ও সীমা বোঝানো-না অতিরিক্ত নরম, না অতিরিক্ত কঠোর হয়ে। এটি শেখায়: diplomatically "না" বলা, নিজের সম্মান বজায় রেখে কথা বলা।

মস্তিষ্কে DBT কীভাবে প্রভাব ফেলে?

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, DBT অ্যামিগডালা ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স–এর কার্যকলাপের ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।

অ্যামিগডালা আবেগের কেন্দ্র; রাগ, ভয়, উত্তেজনা এখান থেকেই আসে।প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তি ও সিদ্ধান্ত।

DBT এই দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ায়।ফলে মানুষ আবেগপ্রবণ অবস্থায়ও যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি স্নায়ু-প্লাস্টিসিটিকে (Neuroplasticity) সক্রিয় করে, অর্থাৎ মস্তিষ্ককে নতুনভাবে শিখতে ও প্রতিক্রিয়া দিতে সক্ষম করে তোলে।

DBT কাদের জন্য উপকারী?

DBT শুরুতে তৈরি হয় বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (BPD)–এর চিকিৎসার জন্য, কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে আরও অনেক মানসিক সমস্যায়—

⇨ তীব্র রাগ বা আবেগজনিত অস্থিরতা

⇨ উদ্বেগ ও বিষণ্নতা

⇨ আত্মক্ষতি বা আত্মহত্যার প্রবণতা

⇨ সম্পর্ক ভাঙার ভয় বা সামাজিক অস্থিরতা

⇨ আসক্তি বা ইমপালসিভ আচরণ

এখন অনেক দেশে DBT ব্যবহার হচ্ছে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট, কিশোরদের ইমোশনাল ট্রেনিং, এমনকি কর্পোরেট মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন প্রোগ্রাম–এও।

DBT শেখার বাস্তব কৌশল-

DBT সাধারণত থেরাপিস্টের নির্দেশনায় হয়, তবে কিছু মৌলিক কৌশল দৈনন্দিন জীবনে চর্চা করা যায়।

১️। "STOP" কৌশল:রাগ বা আতঙ্কের মুহূর্তে

S = Stop (থেমে যান),

T = Take a breath (গভীর শ্বাস নিন),

O = Observe (কি ঘটছে খেয়াল করুন),

P = Proceed mindfully (বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিন)।

২️। "Half-smile" পদ্ধতি:মন খারাপের সময় মুখে হালকা হাসি আনা।এটি স্নায়ুতন্ত্রে প্রশান্তি আনে, রাগ কমায়।

৩️। "Radical Acceptance" (পূর্ণ গ্রহণ):যা ঘটেছে তা অস্বীকার না করে মেনে নেওয়া। মেনে নেওয়া মানে হার মানা নয়;বরং বাস্তবতা বুঝে শান্ত থাকা।

৪️। "Self-soothing" কৌশল: নিজেকে প্রশমিত করা-সঙ্গীত শোনা, প্রাকৃতিক আলো দেখা, গরম চা পান করা বা বই পড়া-এসব ছোট কাজ মস্তিষ্কে শান্ত রাসায়নিক নিঃসরণ ঘটায়।

DBT-এর সাফল্যের  প্রমাণ,

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত DBT সেশন নিয়েছেন

⇨ তাদের আত্মক্ষতির হার ৫০–৬০% পর্যন্ত কমেছে

⇨ আত্মহত্যার চিন্তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে

সম্পর্ক ও আত্মনিয়ন্ত্রণে উন্নতি ঘটেছে

⇨ ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থাৎ এটি শুধু মানসিক চিকিৎসা নয়,একটি বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত জীবনব্যবস্থা।
 

জীবনে কষ্ট, রাগ, অপমান বা দুঃখ-এসবকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়, কিন্তু DBT শেখায় কীভাবে এগুলোর সঙ্গে সহাবস্থান করতে হয়।এটি শেখায়-"নিজেকে অস্বীকার নয়, নিজেকে বুঝে গ্রহণ করা।"যেখানে অন্য থেরাপি কষ্টকে কমানোর চেষ্টা করে, DBT শেখায় কষ্টকে সহ্য করতে শেখা, এবং তাতেই পাওয়া যায় প্রকৃত মুক্তি।আজকের এই দ্রুতগামী, চাপভরা জীবনে DBT শুধু চিকিৎসা নয় বরং একটি ভারসাম্যপূর্ণ, সচেতন ও শান্ত মানসিকতার পথে পদক্ষেপ।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ