গাছের নিচে বসা যেভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে? জানুন বায়োফিলিয়া থিওরির রহস্য!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
কটি গাছের নিচে বসা, সাধারণ চোখে এটি যেন নিছক বিশ্রামের কাজ। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, এটি কেবল মানসিক প্রশান্তি দেয় না, শরীরের গভীর কোষ পর্যন্ত প্রভাব ফেলে। বিশেষত ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের ঝুঁকি কমানোর সঙ্গে প্রকৃতির এই সংস্পর্শের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই ধারণার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে "বায়োফিলিয়া থিওরি" (Biophilia Theory) নামের এক মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিভঙ্গিতে, যেখানে বলা হয়—মানুষ প্রকৃতির সন্তান, আর প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা মানেই সুস্থতার পথে ফেরা।
বায়োফিলিয়া থিওরি কী?
'Biophilia' শব্দটি এসেছে দুইটি গ্রীক শব্দ থেকে-"bio" (জীবন) এবং "philia" (ভালোবাসা)।এই তত্ত্বটি প্রথম প্রস্তাব করেন মার্কিন জীববিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ও. উইলসন, ১৯৮৪ সালে তাঁর বই "Biophilia"-তে। তিনি বলেন,"মানুষের ভেতরে প্রকৃতির সঙ্গে এক গভীর জৈবিক সংযোগ রয়েছে; সেটিই আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার মূল উৎস।" অর্থাৎ, প্রকৃতির সান্নিধ্য কেবল মন ভালো করে না বরং শরীরের জিনগত ও স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সক্রিয় করে।
গাছের নিচে বসলে আমাদের শরীরে কিছু অদৃশ্য পরিবর্তন ঘটে, যেগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানে এখন গুরুত্ব পাচ্ছে।
গাছপালা, বিশেষ করে বনাঞ্চলের বৃক্ষ, বাতাসে ফাইটোনসাইডস নামের রাসায়নিক নির্গত করে।এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান। গবেষণায় দেখা গেছে, এই যৌগ মানবদেহে প্রবেশ করলে ন্যাচারাল কিলার (NK) সেল নামক ইমিউন কোষ সক্রিয় হয়, যা ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।ফলে গাছের নিচে সময় কাটানো মানে শরীরের ভেতরে প্রতিরোধ শক্তি জাগিয়ে তোলা।
শহরের কংক্রিটে থাকা মানুষের শরীরে কর্টিসল (Cortisol) হরমোনের মাত্রা প্রায়ই বেশি থাকে।এই হরমোন দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বাড়ায়।কিন্তু প্রকৃতির নিচে কিছুক্ষণ বসলে কর্টিসলের নিঃসরণ কমে যায়, হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়।
গাছপালা ও সবুজ পরিবেশে বাতাসে নেগেটিভ আয়ন বেশি থাকে। এই আয়ন মস্তিষ্কে অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়ায়, মনোযোগ ও স্নায়ুর কার্যকারিতা উন্নত করে।শরীরের কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
গাছের নিচের ছায়া হালকা ফিল্টার করা সূর্যালোক দেয়, যা ত্বকের ক্ষতি না করেই শরীরে ভিটামিন–ডি তৈরি করে।এই ভিটামিন ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি কোষের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রকৃতির সঙ্গে মস্তিষ্কের সেতুবন্ধন-
প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ভারসাম্যেরও চাবিকাঠি।গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতির শব্দ-পাতার মর্মর, পাখির ডাক, বাতাসের ছোঁয়া—এসব মস্তিষ্কে অ্যালফা ওয়েভ তৈরি করে। এই তরঙ্গ ঘুম, বিশ্রাম ও মানসিক শান্তি এনে দেয়, এবং অ্যামিগডালার (amygdala) অতিরিক্ত উত্তেজনা কমায়।এটি সরাসরি স্ট্রেস–ইনডিউসড ইনফ্লেমেশন (stress-induced inflammation) হ্রাস করে, যা ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। বিজ্ঞানীরা একে বলছেন "Forest Medicine"।
জাপানে একে বলা হয় 'Shinrin-Yoku' (Forest Bathing)।অর্থাৎ বনের বাতাসে শরীর ও মনের স্নান।এখানে রোগীকে প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটাতে উৎসাহিত করা হয়, যেন শরীরের ইমিউন সিস্টেম পুনরুজ্জীবিত হয়। জাপানের মেডিক্যাল সায়েন্সের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত বনাঞ্চলে হাঁটেন বা গাছের নিচে সময় কাটান, তাদের রক্তে NK সেলের সংখ্যা ৩০–৫০% বেশি এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত।
শহুরে জীবনে বায়োফিলিয়ার প্রয়োগ
শুধু বন নয়,ঘরের ভেতরেও বায়োফিলিক পরিবেশ তৈরি করা যায়।
⇨ ঘরে বা অফিসে গাছ রাখা
⇨জানালার পাশে বসে প্রাকৃতিক আলোতে কাজ করা
⇨পাখির শব্দ বা বৃষ্টির রেকর্ডিং শোনা
⇨ প্রাকৃতিক কাঠ বা সবুজ রঙের সাজসজ্জা ব্যবহার
এসব উপায়ে শরীর ও মন প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক প্রশান্তি ও রোগ প্রতিরোধ বাড়ায়।
গাছের নিচে বসা শুধু বিশ্রাম নয়, এটি শরীরের কোষ, স্নায়ু ও মানসিক ভারসাম্যের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। বায়োফিলিয়া থিওরি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ প্রকৃতির অংশ, তাই প্রকৃতির সংস্পর্শে আসলেই শরীর নিজের ভারসাম্যে ফিরে আসে। প্রকৃতির ছায়ায় বসে যে শান্তি আমরা অনুভব করি-সেটি কেবল অনুভূতি নয়, এক প্রমাণিত বায়োকেমিক্যাল প্রতিক্রিয়া, যা শরীরে সুস্থতার সুর তোলে।অর্থাৎ, গাছের নিচে বসা মানে শুধু নিঃশব্দে বিশ্রাম নেওয়া নয় বরং নিজের ভেতরের জীবনশক্তিকে জাগিয়ে তোলা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।