বাঁধাকপি আর মাংসের এমন সংমিশ্রণ, যা ঘরে এনে দেয় তুর্কির স্বাদ!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
তুরস্কের রন্ধনসংস্কৃতি বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ধারক। কাবাব, পিদে, মানতি বা দোলমার মতো পরিচিত খাবারের বাইরে আরও কিছু পদ আছে, যেগুলো তুর্কি ঘরের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি। 'কাপুসকা' (Kapuska) ঠিক তেমনই এক খাবার, যা একদিকে সাধারণ অন্যদিকে ঐতিহ্য, ইতিহাস ও পুষ্টিতে ভরপুর। বাঁধাকপি ও মাংসের মিশ্রণে তৈরি এই ঘন স্টু শুধুই খাবার নয়, বরং একধরনের মানসিক উষ্ণতা, যেটি তুরস্কের শীতল আবহাওয়ায় মানুষকে শরীর ও মনে আরাম দেয়।
'কাপুসকা' শব্দটি মূলত রুশ ও বালকান অঞ্চলের ভাষা থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ "বাঁধাকপি"।অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে বাণিজ্য ও অভিবাসনের মাধ্যমে রুশ, বুলগেরিয়ান ও গ্রিক রান্নার সঙ্গে তুর্কি রান্নার মেলবন্ধন ঘটে। সেই প্রভাবেই এই স্টু খাবারটি তুরস্কে জনপ্রিয় হয়।বিশেষত ২০ শতকের প্রথম ভাগে, যখন তুরস্কের অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছিল, তখন সহজলভ্য বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, টমেটো আর অল্প পরিমাণ মাংস মিশিয়ে পুষ্টিকর খাবার তৈরি করা হতো,সেটিই ছিল কাপুসকার শুরু। তুরস্কে এখনো কাপুসকা একটি "ঘরের খাবার", রেস্তোরাঁয় নয় তবে গৃহিণীদের রান্নাঘরে এর গন্ধ ভেসে আসে শীতের সন্ধ্যায়।
কাপুসকার মূল আকর্ষণ এর ধীর রান্না পদ্ধতি (slow cooking)।তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী হাড়ির ঢাকনায় ধোঁয়াটে আঁচে রান্না করা হয় যাতে প্রতিটি উপাদান ধীরে ধীরে একে অপরের স্বাদে মিশে যায়।
প্রস্তুতি পদ্ধতি:
প্রথমে অলিভ অয়েলে কুচি করা পেঁয়াজ হালকা ভাজা হয়।তাতে যোগ করা হয় টমেটো পেস্ট, পাপরিকা, রসুন ও এক চিমটি গোলমরিচ।এরপর ছোট কাটা মাংস (সাধারণত গরু বা খাসি) দিয়ে ধীরে ধীরে ভাজা হয় যতক্ষণ না হালকা বাদামী রং ধরে। সবশেষে কুচি করা বাঁধাকপি যোগ করে পরিমাণমতো পানি বা মাংসের ঝোল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। প্রায় ৪৫–৬০ মিনিট ধরে নিম্ন আঁচে সিদ্ধ হয় খাবারটি, যাতে বাঁধাকপির মিষ্টি স্বাদ, টমেটোর হালকা টক ভাব এবং মাংসের গভীর স্বাদ একসাথে মিশে যায়। এই ধীর প্রক্রিয়াই কাপুসকার আসল রহস্য।
অঞ্চলভেদে কাপুসকার বৈচিত্র্য রয়েছে! তুরস্কের প্রতিটি অঞ্চলে কাপুসকার আলাদা রূপ দেখা যায়। ব্ল্যাক সি অঞ্চলে এতে টমেটোর পরিবর্তে লাল মরিচ ও শুকনো মরিচের ব্যবহার বেশি, ফলে স্বাদে ঝাঁঝ থাকে।
ইস্তাম্বুলে এটি সাধারণত অলিভ অয়েলে রান্না করা হয়, নিরামিষভাবে; একে বলে Zeytinyağlı Kapuska।অ্যানাটোলিয়ান অঞ্চলে আবার এতে আলু, গাজর ও কিছু স্থানীয় মসলা যোগ করা হয়। এভাবে কাপুসকা তুরস্কের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলনও বটে।
পুষ্টিগত বিশ্লেষণ-
বাঁধাকপি হচ্ছে Brassica oleracea প্রজাতির এক আশ্চর্য সবজি, যার মধ্যে প্রচুর ভিটামিন C, ভিটামিন K, ফোলেট, ক্যালসিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ (যেমন sulforaphane) থাকে। এই যৌগগুলো শরীরের কোষকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধ, বার্ধক্য বিলম্ব ও হৃদ্রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।অন্যদিকে মাংস সরবরাহ করে উচ্চমানের প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক ও ভিটামিন B12- যা রক্ত তৈরিতে ও পেশিশক্তি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।দু'টি উপাদানের একসাথে রান্না মানে হলো সামঞ্জস্যপূর্ণ
একদিকে শরীর পায় শক্তি ও প্রোটিন, অন্যদিকে সবজি থেকে আসে ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
তুর্কি পুষ্টিবিদদের মতে, কাপুসকা এমন একটি খাবার যা "কম উপকরণে সর্বাধিক পুষ্টি" সরবরাহ করে।
কাপুসকা তুরস্কে শুধু খাবারই নয়, পারিবারিক সংহতির প্রতীকও বটে। শীতের বিকেলে পরিবারের সবাই মিলে এক হাড়ি কাপুসকা রান্না করা যেন ঘরোয়া ঐতিহ্যের অংশ।গরম ভাত, দই বা রুটি- যা-ই সঙ্গে থাকুক, এক বাটি কাপুসকা মানুষকে একত্র করে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, গরম ও ঘন খাবার যেমন স্টু বা স্যুপ আমাদের শরীরে সেরোটোনিন নিঃসরণ বাড়ায়, যা মানসিক প্রশান্তি ও তৃপ্তি দেয়। তাই তুর্কিরা কাপুসকাকে শুধু পেট ভরানোর খাবার নয়, বরং "শরীর ও মনের আরামের প্রতীক" হিসেবে দেখে।
আজকের যুগে কাপুসকা তুরস্কের বাইরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
ভেগান সংস্করণে মাংসের পরিবর্তে মসুর ডাল, ছোলা বা টোফু ব্যবহার করা হয়, তবে রান্নার ধীর পদ্ধতি ও বাঁধাকপির আধিপত্য একই থাকে।তুরস্কের অনেক তরুণ রাঁধুনি এখন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণে কাপুসকার নতুন সংস্করণ তৈরি করছেন।কেউ পরিবেশন করছেন ব্রাউন রাইসের সঙ্গে, কেউ বা পরিবেশবান্ধব ভেষজ তেল দিয়ে।
বাঁধাকপির পুষ্টি, মাংসের শক্তি, আর ধীর রান্নার ধৈর্য এই তিনের মিলনে কাপুসকা হয়ে উঠেছে তুর্কি সংস্কৃতির এক গভীর চিত্র।যেভাবে এক বাটি গরম কাপুসকা তুরস্কের শীতে উষ্ণতা আনে, ঠিক তেমনি আমাদেরও মনে করিয়ে দেয় "খাবার কেবল শরীরের জন্য নয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভালোবাসারও বাহক।"
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।