রাতের আবেগপ্রবণতা: কেন এই সময়ে আমরা বেশি অনুভূতিশীল!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দিনের শেষে, যখন আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, শহরের কোলাহল কমে আসে, তখন এক অদ্ভুত নিরবতা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এই সময় অনেকেই হঠাৎ করে নিজের জীবনের কথা ভাবতে শুরু করেন- পুরোনো সম্পর্ক, অসম্পূর্ণ স্বপ্ন, অথবা কোনো না বলা কথা। প্রশ্নটা তখনই আসে, কেন রাতে মানুষ এত বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে? এটি কেবল কাব্যিক বা মানসিক বিষয় নয়, এর পেছনে রয়েছে নিউরোসায়েন্স ও ঘুমচক্রের বাস্তব ব্যাখ্যা।
আমাদের শরীর একটি সার্কাডিয়ান রিদম বা জৈবিক ঘড়ির অধীনে কাজ করে, যা ঘুম, জাগরণ, হরমোন নিঃসরণ, এমনকি আবেগ নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত প্রভাবিত করে। দিনের বেলায় কর্টিসল নামের এক ধরনের 'স্ট্রেস হরমোন' বেশি সক্রিয় থাকে, যা আমাদের মনোযোগ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা জাগিয়ে রাখে। কিন্তু সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে এই কর্টিসলের মাত্রা কমতে থাকে, আর মেলাটোনিন বাড়তে শুরু করে, যা ঘুমের প্রস্তুতি নেয়। এই পরিবর্তনের সময় মস্তিষ্কের 'প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স' ধীরে ধীরে কম সক্রিয় হয়, আর 'লিম্বিক সিস্টেম' তুলনামূলক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে রাতে যুক্তির ভার কমে, আবেগের প্রবাহ বাড়ে। তাই আমরা রাতে এমন কথাও ভাবি বা বলি, যা দিনের আলোয় হয়তো অসম্ভব মনে হতো।
দিনের ব্যস্ততায় আমাদের চিন্তাগুলো স্তর স্তর শব্দ, কাজ ও তথ্যের নিচে চাপা পড়ে থাকে। রাতে যখন চারপাশের শব্দ কমে, আলো ম্লান হয়, তখন মস্তিষ্ক পায় এক ধরনের quiet processing time অর্থাৎ, চিন্তা করার অবকাশ। এই সময় অতীতের স্মৃতি, না বলা অনুভূতি, বা চাপা কষ্ট মস্তিষ্কের সামনে ফিরে আসে।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, এই সময়টায় মানুষ নিজের আবেগের সঙ্গে বেশি সংযুক্ত হয়, কারণ বাইরের মনোযোগ বিভ্রাট কমে যায়।তাই রাতে হঠাৎ করে কারও জন্য মায়া,অনুশোচনা বা ভালোবাসা অনুভূত হওয়া একেবারে স্বাভাবিক।
রাতে ঘুম না আসা বা দেরিতে ঘুমানো মানুষদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও ডোপামিন হরমোনের ওঠানামা ঘটে, যা মুডে বড় পরিবর্তন আনে।গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত রাতে জেগে থাকে, তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতার প্রবণতা বেশি।ঘুমের অভাবে 'অ্যামিগডালা' অত্যধিক সক্রিয় হয়, কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করার অংশ,'প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স' কম প্রতিক্রিয়াশীল থাকে। ফলে ছোট বিষয়েও মন ভেঙে যায়, পুরোনো ঘটনা মনে পড়ে, আর আবেগ বেড়ে যায়।
রাত মানেই এক ধরনের নীরব আত্মসমীক্ষার সময়। এই নির্জনতায় মস্তিষ্ক অবচেতনভাবে দিনের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিগুলো প্রক্রিয়াকরণ শুরু করে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় memory consolidation যেখানে আমরা দিনের ঘটনা, সম্পর্ক ও অনুভূতিগুলোর অর্থ খুঁজে পাই।এই সময়েই অনেকের মনে পড়ে পুরোনো প্রেম, হারানো মানুষ বা নিজের অপূর্ণতা। আলো কমে গেলে, বাইরের বিশ্বের প্রভাব কমে যায়, আর ভেতরের বিশ্ব অর্থাৎ, নিজের মন জেগে ওঠে।
রাতে যখন অনেকে একা থাকে, তখন সামাজিক সংযোগের ঘাটতি মানসিক শূন্যতা তৈরি করে। এই শূন্যতা পূরণ করতে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটায়, পুরোনো চ্যাট পড়ে, অথবা আবেগপূর্ণ পোস্ট করে। এই আচরণ আসলে এক ধরনের "self-soothing mechanism", নিজেকে মানসিকভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়াস।তবে অতিরিক্ত রাতজাগা এবং আবেগী সিদ্ধান্ত, যেমন: কারও সঙ্গে কথা বলা, মেসেজ পাঠানো, বা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া- অনেক সময় পরের দিন অনুশোচনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তখন মস্তিষ্কের যুক্তিপ্রবণ অংশ কার্যত "ঘুমিয়ে" থাকে।
রাতের আবেগ মানুষকে দুর্বল করে না বরং সেটাই প্রমাণ করে, আমরা এখনো অনুভব করতে পারি, ভাবতে পারি। তবে বিজ্ঞান বলে, এই সময় আবেগের মাত্রা বেড়ে যায় মূলত হরমোন, ঘুমচক্র ও পরিবেশগত নিস্তব্ধতার কারণে।তাই পরামর্শ একটাই আর তা হলো - রাতের আবেগকে স্বীকার করুন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিন সকালের আলোয়। কারণ আবেগের আলো যেমন রাতকে মানবিক করে তোলে, যুক্তির আলো তেমনি আমাদের জীবনকে স্থির করে রাখে। রাতের নিস্তব্ধতা কেবল ঘুমের নয়, নিজের ভেতরকে দেখার আয়না। সেখানে আবেগ জাগে, কিন্তু আলো ফোটে যুক্তির মধ্যেই।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।