শক্তি চাই? Breadfruit খেলেই পাবেন কার্বোহাইড্রেটের সেরা উৎস!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
খাদ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পৃথিবীতে এমন কিছু ফল আছে, যেগুলো কেবল খাবার নয়, বরং একটি জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার ইতিহাস বহন করে। ব্রেডফ্রুট (Breadfruit) তেমনই এক বিস্ময়কর ফল,দেখতে ফলের মতো, কিন্তু খেতে আলুর মতো; পুষ্টিতে ভরপুর, আবার রান্নায় বহুমুখী। এটি প্রাকৃতিকভাবে একদিকে শক্তির জোগানদাতা, অন্যদিকে পৃথিবীর উষ্ণ অঞ্চলের মানুষদের প্রধান খাদ্য বিকল্প হিসেবেও কাজ করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
ব্রেডফ্রুটের বৈজ্ঞানিক নাম Artocarpus altilis। এটি মূলত প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জ, নিউ গিনি, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন অঞ্চলের দেশীয় গাছ। প্রাচীনকালে এই ফলকে বলা হতো "বেঁচে থাকার ফল", কারণ এটি এক গাছেই শত শত ফল দেয়, এবং একটি পরিবারকে বছরের অনেকটা সময় খাদ্য সরবরাহ করতে পারে।১৮ শতকে ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা (বিশেষ করে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম ব্লাই, যিনি বিখ্যাত Mutiny on the Bounty অভিযানের জন্য পরিচিত) ব্রেডফ্রুট গাছ ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে নিয়ে যান, দাস শ্রমিকদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। এরপর থেকে এটি বিশ্বের বহু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে।
ব্রেডফ্রুট দেখতে সবুজ ও খসখসে বাইরের আবরণে ঢাকা একটি বড় ফল, যার ভেতরের অংশ সাদা ও মাড়যুক্ত। এটি সিদ্ধ, ভাজা, পুড়িয়ে বা স্টু করে খাওয়া যায়।স্বাদে ও গঠনে এটি অনেকটাই আলুর মতো, তাই একে "tropical potato" বলেও ডাকা হয়।তবে পুষ্টিগত দিক থেকে ব্রেডফ্রুট আলুর চেয়ে অনেক বেশি উপকারী:
এতে কার্বোহাইড্রেট প্রচুর পরিমাণে থাকে (প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ২৭–৩০ গ্রাম)।পাশাপাশি ফাইবার, ভিটামিন C, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামও যথেষ্ট থাকে। যেখানে আলু মূলত স্টার্চ সরবরাহ করে, ব্রেডফ্রুট দেয় আরও জটিল কার্বোহাইড্রেট, যা ধীরে ধীরে শক্তি দেয় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বৃদ্ধি করে না।
ব্রেডফ্রুট হচ্ছে একধরনের কম ফ্যাট, গ্লুটেন-মুক্ত এবং উচ্চ ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার। বিজ্ঞানীরা এর পুষ্টিগুণকে 'balanced tropical starch' বলে অভিহিত করেন। এর কিছু প্রধান উপকারিতা হলো:
⇨ শক্তির প্রাকৃতিক উৎস:কার্বোহাইড্রেটের ঘনত্ব ও প্রাকৃতিক শর্করা এটিকে শক্তির চমৎকার উৎস করে তুলেছে, বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রম বা গরম আবহাওয়ায় শরীরের জন্য তা দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে।
⇨হৃদ্স্বাস্থ্যে সহায়ক:ব্রেডফ্রুটে থাকা ফাইবার কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
⇨ রক্তে শর্করার ভারসাম্য:যদিও এটি কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ, এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাঝারি, অর্থাৎ ধীরে ধীরে রক্তে শর্করা ছাড়ে, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে উপকারী হতে পারে।
⇨রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি:এতে উপস্থিত ভিটামিন C শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
⇨ ত্বক ও হাড়ের যত্নে: ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ ত্বকের কোষ ও হাড়ের গঠনকে মজবুত করে।
ব্রেডফ্রুটের বিশেষত্ব হলো এর বহুমুখিতা।একই ফল কাঁচা অবস্থায় আলুর মতো রান্না করা যায়, আবার পাকা অবস্থায় তা মিষ্টি ও ক্রিমি হয়ে যায়, যা দিয়ে তৈরি করা যায় পুডিং, কেক বা প্যানকেকের মতো খাবার।ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এটি ভাজা বা ভর্তা করে খাওয়া হয়,হাওয়াই ও ফিজিতে এটি পাথরের চুলায় পুড়িয়ে পরিবেশন করা হয়, আর দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকেই এটি সবজির মতো রান্না করেন পেঁয়াজ, মরিচ ও নারকেল দুধ দিয়ে। আধুনিক খাদ্যবিজ্ঞানীরা ব্রেডফ্রুট থেকে গ্লুটেন-মুক্ত ময়দা (breadfruit flour) তৈরি করছেন, যা বেকিং ও পাস্তা তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। এটি খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ব্রেডফ্রুট গাছ একবার লাগালে কয়েক দশক ধরে ফল দেয়।এটি কম পানি ও সার প্রয়োজন করে, মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক হিসেবে কাজ করে। জাতিসংঘের কৃষিবিষয়ক গবেষণায় ব্রেডফ্রুটকে "food security crop" হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, বিশেষত যেসব অঞ্চলে আলু বা গম উৎপাদন কঠিন, সেখানে এটি বিকল্প খাদ্য হিসেবে বিশাল সম্ভাবনাময়।
ব্রেডফ্রুট হলো এক অনন্য ফল, যেখানে একসাথে মিশে আছে ফলের মিষ্টি গুণ, শস্যের পুষ্টি ও আলুর বিকল্প শক্তি। ব্রেডফ্রুট এক ফল নয় শুধু, ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও। একটি ফল, যা ইতিহাসের অংশ থেকেও আজ আবার বিজ্ঞান ও পুষ্টির আলোচনায় ফিরে এসেছে, নতুন প্রজন্মের শক্তির উৎস হিসেবে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।