সমতার ভেতর লুকানো ক্ষমতার খেলা:জাতিসংঘের ভোটে বৈষম্য!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
জাতিসংঘ (UN) প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল—বিশ্বের সব দেশকে একটি সমান মঞ্চ দেওয়া, যেখানে ছোট বা বড়, ধনী বা দরিদ্র সবাই আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তে অংশ নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কিছু দেশের কথা বেশি গুরুত্ব পায়, তাদের সিদ্ধান্তই অনেক সময় চূড়ান্ত হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্নটা এখানেই, যখন সবাই ভোট দেয়, তখন কেন সবার কণ্ঠস্বর সমানভাবে শোনা যায় না?
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনকার পরাশক্তি দেশগুলো:যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন), ফ্রান্স ও চীন এই সংস্থার নীতিনির্ধারণে মূল ভূমিকা নেয়।
তাদের দাবি ছিল, যারা বিশ্বযুদ্ধে "শান্তি রক্ষায়" বিজয়ী ভূমিকা নিয়েছে, তারাই যেন ভবিষ্যৎ বিশ্ব নিরাপত্তায় নেতৃত্ব দেয়।এইভাবেই তৈরি হয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ (UN Security Council), যার পাঁচটি স্থায়ী সদস্য (Permanent Members) হলো ওই পাঁচ দেশ। এখান থেকেই শুরু হয় বৈষম্যের কাঠামো।
এই পাঁচ দেশের প্রতিটি সদস্যের হাতে আছে একটি বিশেষ ক্ষমতা,ভেটো পাওয়ার (Veto Power)।এর মানে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যদি কোনো প্রস্তাব ১৪টি দেশ সমর্থনও করে, কিন্তু এই পাঁচ দেশের যেকোনো একটি দেশ "না" বলে, তাহলে সেই প্রস্তাব কার্যকর হয় না। অর্থাৎ, এক দেশের আপত্তিতেই থেমে যেতে পারে গোটা বিশ্বের সিদ্ধান্ত।
এই প্রক্রিয়া কার্যত জাতিসংঘের "গণতান্ত্রিক নীতি"-কে দুর্বল করে দেয়, কারণ তখন ভোট নয়, ক্ষমতাই নির্ধারণ করে ফলাফল।
উদাহরণস্বরূপ
◑ যুক্তরাষ্ট্র বহুবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে।
◑ রাশিয়া ইউক্রেন ইস্যুতে নিজের স্বার্থ রক্ষায় ভেটো ব্যবহার করেছে।
◑ চীন বহু প্রস্তাবে নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধিতা করেছে।ফলে মানবাধিকার, যুদ্ধবিরতি বা জলবায়ু নীতির মতো বৈশ্বিক বিষয়ে অনেক সময় সিদ্ধান্ত স্থবির হয়ে পড়ে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (General Assembly) ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই ভোট সমান—এক দেশ, এক ভোট।কিন্তু এখানকার সিদ্ধান্তগুলো "বাধ্যতামূলক নয়" (non-binding), অর্থাৎ এগুলো শুধুমাত্র সুপারিশ হিসেবে থাকে।যেমন, যদি সাধারণ পরিষদে কোনো দেশ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়, সেটি কার্যকর করতে হয় নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনে। ফলে, বাস্তব ক্ষমতা থাকে না সাধারণ পরিষদের হাতে, বরং থাকে সেই পাঁচ স্থায়ী সদস্যের হাতে।
এই কাঠামোই তৈরি করেছে ক্ষমতার বৈষম্য,যেখানে আইনি ভোটের সমতা থাকলেও, বাস্তব প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করে অল্প কয়েকটি দেশ।
জাতিসংঘের বাজেটের বড় অংশ আসে ধনী দেশগুলোর অনুদান থেকে। যুক্তরাষ্ট্র একাই মোট বাজেটের প্রায় ২২% দেয়। ফলে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর সিদ্ধান্ত ও মতামত স্বাভাবিকভাবেই বেশি গুরুত্ব পায়।এই আর্থিক নির্ভরতা ছোট দেশগুলোর কণ্ঠস্বরকে পরোক্ষভাবে দুর্বল করে দেয়।অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের রাজনৈতিক জোট, সামরিক শক্তি ও উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে অন্য দেশগুলোর ওপর নরম চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে "ভোটে সমতা" থাকলেও, "প্রভাবের সমতা" থাকে না।
গত কয়েক দশক ধরে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ দাবি জানিয়ে আসছে, নিরাপত্তা পরিষদে আরও স্থায়ী সদস্য যুক্ত করতে হবে।তাদের যুক্তি হলো, বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন ভিন্ন; ভারত, জার্মানি, জাপান বা ব্রাজিলের মতো দেশগুলোও এখন বড় শক্তি, কিন্তু তাদের কোনো স্থায়ী আসন নেই।তবে এই সংস্কার সহজ নয়। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামো বদলাতে হলে সেই পাঁচ দেশকেই সম্মতি দিতে হবে,যারা নিজেরাই বর্তমান প্রভাব ধরে রাখতে চায়।
জাতিসংঘ সমতার আদর্শে তৈরি হলেও, তার কাঠামোতে রয়ে গেছে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্য। ভোটের অধিকার সমান, কিন্তু সিদ্ধান্তের ক্ষমতা অসম।যেখানে একজন ভোট দিয়ে পরিবর্তন চান, আর অন্যজন "না" বলে তা থামিয়ে দিতে পারেন, সেখানে গণতন্ত্র নয়, কূটনৈতিক প্রভাবই হয়ে ওঠে আসল চালিকাশক্তি।এই বৈষম্য আমাদের শেখায় বিশ্বব্যবস্থায় সমতা কেবল ঘোষণায় নয়, কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত না হলে, "জাতিসংঘ"ও হয়ে ওঠে নির্বাচিত কণ্ঠের সংগঠন, সর্বজনের নয়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।