ঘরোয়া সার বনাম কেমিক্যাল সার গাছের জন্য কোনটা নিরাপদ!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
গাছ যেমন সূর্যের আলো ও পানির ওপর নির্ভর করে, তেমনি মাটির পুষ্টিও তার জীবনের মেরুদণ্ড। কিন্তু টবে লাগানো গাছ বা ছোট বাগানের মাটি ধীরে ধীরে দরিদ্র হয়ে যায়, কারণ প্রতিনিয়ত গাছ মাটি থেকে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়ামসহ নানা খনিজ শোষণ করে নেয়। তাই মাটির পুষ্টি ফিরিয়ে দিতে দরকার সারের সহায়তা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় কোন সার নিরাপদ? ঘরে তৈরি প্রাকৃতিক সার, না কি বাজারের কেমিক্যাল সার?
প্রকৃতির ঘরোয়া সার মূলত তৈরি হয় এমন উপাদান থেকে, যেগুলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রায় অযত্নেই ফেলে দেওয়া হয়-ফল-সবজির খোসা, চায়ের পাতা, ডিমের খোসা, কফির অবশিষ্টাংশ, শুকনো পাতা বা গোবর। এই উপাদানগুলো সময়ের সঙ্গে পচে গিয়ে মাটির ভেতর 'হিউমাস' নামের এক জৈব পদার্থ তৈরি করে, যা মাটির অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়াকে সক্রিয় রাখে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো গাছের শিকড়ের জন্য পুষ্টি ভেঙে সহজে শোষণযোগ্য করে দেয়। ফলে গাছ ধীরে ধীরে কিন্তু স্থায়ীভাবে পুষ্টি পায়, আর মাটির গঠনও টিকে থাকে উর্বর ও জীবন্ত অবস্থায়।
ঘরোয়া সারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি মাটির অণুজীবের জীবনচক্র বজায় রাখে। মাটির জীবাণু যত বেশি সক্রিয়, গাছের পুষ্টি গ্রহণ তত উন্নত হয়। এছাড়া এই সার মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখে, pH ভারসাম্য ঠিক রাখে এবং গাছের শিকড়ের চারপাশে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করে। ফলস্বরূপ, গাছের বৃদ্ধি স্থিতিশীল হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে।
অন্যদিকে, কেমিক্যাল সার দ্রুত ফল দেখায়, এমনকি কয়েক দিনের মধ্যেই গাছের পাতা সবুজ হয়ে ওঠে, ফুল ফোটে। কিন্তু এই দ্রুততা আসে রাসায়নিক যৌগের ঘন প্রভাবে। ইউরিয়া, সুপারফসফেট বা পটাশের মতো রাসায়নিক সারে পুষ্টি মাত্রা বেশি থাকে, যা তাত্ক্ষণিকভাবে শিকড়ে প্রবেশ করে। ফলে গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মাটির স্বাভাবিক জৈব ভারসাম্য নষ্ট হয়। এই সারের লবণ জাতীয় যৌগ সময়ের সঙ্গে মাটিতে জমে থাকে, যা শিকড়ের পানি শোষণ কমায় এবং মাটিকে ধীরে ধীরে শক্ত ও অনুজীবহীন করে তোলে। ফলে প্রথম দিকে গাছ ভালো দেখালেও পরের বছরগুলোতে সেই মাটিতে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। একে বলা হয় "মাটির ক্লান্তি" বা soil fatigue।আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কেমিক্যাল সার কেবল নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম দেয়, কিন্তু জিঙ্ক, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম বা সালফারের মতো ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিগুলো দেয় না।এর ফলে গাছ হয়তো দ্রুত বড় হয়, কিন্তু তার গুণমান ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
ঘরোয়া সার তুলনামূলক ধীর হলেও গাছকে দীর্ঘমেয়াদে শক্ত ভিত্তি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, রান্নাঘরের আবর্জনা পচিয়ে তৈরি কম্পোস্ট সারে প্রায় সব পুষ্টি উপাদান থাকে। কলার খোসা পটাশের উৎস, ডিমের খোসা ক্যালসিয়ামের, কফির গুঁড়ো নাইট্রোজেনের, আর চায়ের পাতা ফসফরাসের প্রাকৃতিক সরবরাহ করে। এই সারের বিশেষত্ব হলো-এগুলো গাছকে পুষ্টি দেয় ক্রমশ ও সমানভাবে, হঠাৎ নয়।গোবর সারও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কৃষিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে মাটির জীবাণু ফিরে আসে, মাটির গঠন নরম ও বায়ুচলাচলযোগ্য হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, জৈব সারের ব্যবহারে মাটির অণুজীব সক্রিয় থাকে, ফলে পরবর্তী মৌসুমেও একই মাটিতে ফসল ফলানো সহজ হয়।
আজকের বৈজ্ঞানিক কৃষিতে অনেকেই বলছেন, ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারই মূল কথা। অর্থাৎ, সামান্য পরিমাণে কেমিক্যাল সার ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে জৈব সার মেশালে মাটির জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয় না। এতে গাছ পায় দ্রুত ফলন ও স্থায়ী পুষ্টি দুই-ই।তবে শহুরে টবের গাছ বা ছাদের বাগানের জন্য ঘরোয়া সারই সবচেয়ে নিরাপদ। এতে রাসায়নিক দূষণ নেই, গাছের মূল পোড়ে না, এবং পরিবেশও থাকে সুরক্ষিত।
শেষমেশ, সার মানে শুধু গাছের খাবার নয়, মাটির প্রাণশক্তির প্রতিফলন। রাসায়নিক সার হয়তো কিছুদিনে সবুজ পাতার আশ্বাস দেয়, কিন্তু প্রকৃতি ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়া জানায়-উর্বরতা কমে, জীবাণু মরে যায়, পানি জমে থাকে না। বিপরীতে ঘরোয়া সার প্রকৃতির চক্র পূর্ণ করে, মাটিকে দেয় নতুন জীবন ও স্থায়ী ভারসাম্য।অল্প সময়ের ফল নয়, দীর্ঘমেয়াদি জীবন চাইলে ঘরোয়া সারই গাছের সত্যিকারের পুষ্টি।আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।