মাল্টিটাস্কিং নয়, এক সময়ে এক কাজই বুদ্ধিমানের পরিচয় !
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের যুগে "মাল্টিটাস্কিং" যেন একধরনের দক্ষতার প্রতীক। অফিসে কাজ করতে করতে মেসেজ দেওয়া, ল্যাপটপে কাজ চালিয়ে যাওয়া অবস্থায় ফোনে মিটিং শোনা, কিংবা পড়ার সময়ই সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করা-সবকিছু যেন "দ্রুততার" যুগের স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ বলছে, মাল্টিটাস্কিং আসলে আমাদের শেখার ক্ষমতা ও মস্তিষ্কের মনোযোগকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
নিউরোসায়েন্স অনুযায়ী, মানব মস্তিষ্ক একই সময়ে একটি মাত্র "গভীর মনোযোগের কাজ" করতে পারে। যখন আমরা একাধিক কাজে মন দিই, তখন মস্তিষ্ক একসঙ্গে কাজ করে না বরং প্রতি সেকেন্ডে দ্রুত কাজগুলোর মধ্যে "সুইচ" করে।এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় "attention switching", যা প্রতিবারেই কয়েক মিলিসেকেন্ড সময় নেয়। দেখতে ছোট সময় মনে হলেও, যখন কেউ ক্রমাগত কাজ বদলায়।যেমন,লেখার মাঝেই ফোন দেখা, তারপর আবার কাজে ফেরা,তখন সেই কয়েক মিলিসেকেন্ড যোগ হয়ে মানসিক ক্লান্তি, ভুল, ও মনোযোগের ক্ষয় সৃষ্টি করে।
শেখার প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো হিপোক্যাম্পাস, যা নতুন তথ্যকে দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে রূপান্তরিত করে। যখন আমরা পড়ার সময় বা শেখার সময় অন্য কাজে মন দিই, তখন মস্তিষ্ক সেই তথ্যকে "অস্থায়ী স্মৃতি"তে আটকে রাখে, দীর্ঘমেয়াদি শেখায় রূপান্তরিত করতে পারে না।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা পড়ার সময় ফোন বা মেসেজ চেক করে, তাদের তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতা প্রায় ৪০% পর্যন্ত কমে যায়।অর্থাৎ, তারা বেশি সময় ব্যয় করলেও কম শেখে,এটাই "মাল্টিটাস্কিং ইল্যুশন"।
প্রতিবার মনোযোগ সরানো মানে মস্তিষ্ককে নতুনভাবে "রিফোকাস" করতে হয়, যা অনেক শক্তি নেয়। এই শক্তি আসে মস্তিষ্কের গ্লুকোজ খরচের মাধ্যমে। ফলে বারবার মনোযোগ বদলালে ক্লান্তি দ্রুত বাড়ে, মানসিক স্থিতিশীলতা কমে যায়, এমনকি স্ট্রেস হরমোনও বেড়ে যায়।ফলে কাজের শেষে মানুষ ভাবে-"আজ সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম, কিন্তু কিছুই শেষ করতে পারলাম না।"আসলে এটি মনোযোগের ছিন্নভিন্ন অবস্থার ফল।
"দ্রুততা" নয়, "গভীরতা"ই শেখার চাবিকাঠি!
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ মাল্টিটাস্কিং করলে মনে হয় যেন অনেক কাজ একসঙ্গে হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে এটি কেবল মনোযোগের ভ্রম।মাল্টিটাস্কিং শেখাকে পৃষ্ঠতলে রাখে,তথ্য মনে থাকে অল্প সময়ের জন্য গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছায় না।অন্যদিকে, এক সময়ে এক কাজ করলে মস্তিষ্ক সেই তথ্যকে সংযোগ তৈরি করে সংরক্ষণ করে।এ কারণেই "ডিপ লার্নিং" বা "গভীর মনোযোগের শেখা" আজকের শিক্ষাবিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোচিত ধারণা।
আজকের ডিজিটাল যুগে মনোযোগ ধরে রাখা আরও কঠিন। প্রতি কয়েক মিনিটেই নোটিফিকেশন, ইমেইল, বা বিজ্ঞপ্তি আমাদের মস্তিষ্ককে কাজ বদলাতে বাধ্য করে।গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কর্মী যদি মনোযোগ হারায়, পুনরায় কাজের গভীরতায় ফিরতে গড়ে ২৩ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগে।অর্থাৎ, যত বেশি নোটিফিকেশন বা বিঘ্ন, শেখা বা কাজের মান তত কম।
মনোযোগ ধরে রাখার বৈজ্ঞানিক উপায়-
মনোযোগ এক প্রকার পেশির মতো,চর্চা করলে তা শক্ত হয়। বিজ্ঞানীরা কিছু কার্যকর পদ্ধতির কথা বলেন:
☞ পোমোডোরো টেকনিক: ২৫ মিনিট নিরবচ্ছিন্ন কাজ, ৫ মিনিট বিরতি।
☞ ডিজিটাল ডিটক্স: শেখার সময় ফোন দূরে রাখা বা নোটিফিকেশন বন্ধ করা।
☞ মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস: প্রতিদিন কিছু সময় ধ্যান বা নিঃশব্দ পর্যবেক্ষণে ব্যয় করা।
☞ এক লক্ষ্য, এক ফোকাস: প্রতিবার একটিমাত্র কাজের ওপর পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া।
মাল্টিটাস্কিং আমাদের সময় "বাঁচায়" বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে এটি মস্তিষ্কের শক্তি ও শেখার গভীরতা নষ্ট করে। একসঙ্গে বহু কাজে না গিয়ে, একটিমাত্র কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলে ফলাফল হয় দীর্ঘস্থায়ী ও মানসম্পন্ন।মস্তিষ্ক দ্রুত নয়, গভীরভাবে কাজ করতে চায়। তাই শেখার সত্যিকারের গতি লুকিয়ে আছে ধীরতার ভেতরেই,যেখানে মনোযোগ থাকে এক আর অর্জন হয় পূর্ণ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।