আপনি কি জানেন, অন্যকে দোষারোপ করা এক অচেতন প্রতিরক্ষা কৌশল!
 
                                        
                                    - Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি, কোনো কিছু ভুল হলেই আমাদের মুখ থেকে প্রথমেই বেরিয়ে আসে,"ওর জন্যই এমন হলো!" অন্যদিকে নিজের ভুলের ক্ষেত্রে আমরা বলি, "সময়টা খারাপ ছিল" কিংবা "পরিস্থিতি আমায় বাধ্য করেছে।" প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন নিজের ভুলের চেয়ে অন্যের ভুল দেখতে বেশি আগ্রহী?এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের মস্তিষ্ক, আত্মসম্মানবোধ এবং সামাজিক মনস্তত্ত্বের জটিল সম্পর্কের ভেতর।
মনোবিজ্ঞানীরা একে বলেন "Self-Serving Bias",যা এমন এক মানসিক প্রবণতা, যেখানে মানুষ নিজের ইতিবাচক দিকগুলোকে নিজের যোগ্যতার ফল মনে করে, কিন্তু নেতিবাচক ফলের দায় চাপায় অন্যের বা পরিস্থিতির ঘাড়ে। এই প্রবণতা আসলে এক ধরনের অচেতন আত্মরক্ষার ব্যবস্থা (psychological defense mechanism)।
আমাদের মস্তিষ্ক সব সময় চায় নিজেকে "ভালো মানুষ", "সফল মানুষ" বা "যোগ্য মানুষ" হিসেবে বিশ্বাস করতে।যখন কোনো ব্যর্থতা আসে, তখন সেই ধারণা টলে যায়। তাই মন দ্রুত এমন একটি গল্প বানায়, যেখানে দায় অন্যের। এভাবেই আমরা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখি, আত্মসম্মান বাঁচাই।
১৯৭৭ সালে সমাজমনোবিজ্ঞানীরা এক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেন,"Fundamental Attribution Error"।এর মতে, আমরা যখন অন্যের কোনো আচরণ দেখি, তখন ধরে নিই সেটি তার চরিত্র বা ব্যক্তিত্বের ফল। কিন্তু নিজের আচরণ ব্যাখ্যা করার সময় পরিস্থিতিকে দায়ী করি। উদাহরণ হিসেবে ধরুন:আপনি অফিসে দেরি করেছেন। আপনি বলবেন, "রাস্তায় জ্যাম ছিল।" কিন্তু সহকর্মী দেরি করলে বলবেন, "ও অলস!" এই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যই আমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক পক্ষপাত।আমরা নিজের জন্য "যুক্তি" খুঁজি, অন্যের জন্য "বিচার" করি।
মানবসমাজ প্রতিযোগিতামূলক।সাফল্য, মর্যাদা, চেহারা, সবকিছুতেই তুলনা চলে।এই তুলনা থেকেই জন্ম নেয় এক ধরনের "Social Comparison Bias"।অন্যের ভুল ধরতে পারলে আমাদের মনে হয় আমরা তুলনামূলকভাবে ভালো।
এটি আত্মতৃপ্তি দেয়, নিজের নিরাপত্তাবোধ বাড়ায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এই প্রবণতা বেশি দেখা যায় যারা নিজেদের নিয়ে অনিশ্চিত বা আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি অনুভব করেন, তাদের মধ্যে। অন্যের দুর্বলতা খুঁজে বের করে তারা নিজের অবস্থানকে মানসিকভাবে উঁচুতে রাখেন, এটা আসলে আত্মরক্ষারই এক রূপ।
 
মস্তিষ্কের দুই গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে কাজ করে-
১। Amygdala: আবেগ ও ভয় নিয়ন্ত্রণ করে
২। Prefrontal Cortex: যুক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে
 
যখন আমরা অন্যের ভুল দেখি, তখন Amygdala দ্রুত আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া দেয়- রাগ, হতাশা বা সমালোচনা।কিন্তু নিজের ভুল দেখলে Prefrontal Cortex সক্রিয় হয়- যুক্তি, ব্যাখ্যা, আত্মসমর্থন। এই দুই সিস্টেমের ভারসাম্য না থাকলেই মানুষ হয়ে ওঠে "দোষ অনুসন্ধানী"।
শিশু বয়স থেকেই আমরা শেখি,ভালো করলে প্রশংসা, খারাপ করলে বকুনি। এই শিক্ষা থেকে তৈরি হয় "Fear of Blame",মানে কেউ ভুল করলে তাকে দোষী ধরা হবে।ফলে বড় হয়ে আমরা নিজের ভুল লুকাতে শিখি, অন্যের ভুল প্রকাশে পারদর্শী হই। অনেক সমাজে দোষ দেখানোই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হিসেবে ধরা হয়, যেখানে কেউ ভুল ধরলে মনে করা হয়, সে বেশি জ্ঞানী বা সচেতন।এই মানসিক কাঠামোই আমাদের অজান্তে অন্যের সমালোচনায় উৎসাহী করে তোলে।
অন্যের দোষ আগে দেখা শুধু ব্যক্তিগত মানসিকতা নয়, কর্মক্ষেত্রে ও সম্পর্কে তার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়।গবেষণা বলছে, যেসব দলে "blame culture" তৈরি হয়, অর্থাৎ যেখানে সবাই দায় এড়াতে চায়, সেখানে সহযোগিতা কমে, উদ্ভাবন বন্ধ হয়, এবং মানসিক চাপ বাড়ে।সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য, যদি দু'জনের কেউ নিজের ভুল না মেনে নিয়ে শুধু অপরজনের ত্রুটি খোঁজে, তবে বিশ্বাস ভাঙে, সংযোগ দূরে সরে যায়।
অন্যের দোষ দেখা পুরোপুরি খারাপ নয়, এটি আমাদের সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তির অংশ। কিন্তু যখন এটি অতিরিক্ত হয়, তখন তা মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে। কিছু সচেতন অভ্যাস এই প্রবণতা কমাতে সাহায্য করতে পারে-
☞ নিজেকে প্রশ্ন করুন: "আমি যদি তার জায়গায় থাকতাম, আমিও কি এমন করতাম?"
☞ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করুন: হয়তো যার ভুল আপনি দেখছেন, সে মানসিক চাপ, ভয় বা ক্লান্তিতে ভুগছে।
☞ নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করুন: ভুল করা মানবিক- এই উপলব্ধিই সহানুভূতি বাড়ায়।
☞ সচেতন প্রতিক্রিয়া চর্চা করুন: কাউকে দোষারোপ করার আগে একটু বিরতি দিন। এই "pause"-টিই মস্তিষ্ককে যুক্তি ফিরিয়ে আনে।
 
অন্যের দোষ দেখা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা, কিন্তু সব সময় তা সঠিক নয়। যখন আমরা এই প্রবণতাকে চিনতে পারি, তখনই শুরু হয় প্রকৃত আত্ম-উন্নয়ন। মানুষ হিসেবে আমাদের প্রকৃত পরিপক্বতা হলো-নিজের ভুল বুঝে নেওয়া এবং অন্যের ভুল ক্ষমা করার ক্ষমতা অর্জন।দোষ খুঁজতে চাইলে পুরো দুনিয়া ভুল পাবেন, কিন্তু বোঝার চেষ্টা করলে প্রতিটি ভুলের মধ্যেই শেখার সুযোগ আছে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।
 
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    