ওষুধ নয়, বিশ্বাসেই কাজ হয়! প্লাসিবো ইফেক্টের অবিশ্বাস্য বিজ্ঞান

ওষুধ নয়, বিশ্বাসেই কাজ হয়! প্লাসিবো ইফেক্টের অবিশ্বাস্য বিজ্ঞান
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ওষুধ না খেয়েও অনেকের রোগ সেরে যায়। কখনও স্রেফ 'চিনি খাওয়ার মতো ট্যাবলেট' খেয়ে মানুষ বলে ওঠে-"এখন অনেক ভালো লাগছে!"। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই বিস্ময়কর ঘটনাকে বলা হয় "Placebo Effect",যেখানে বিশ্বাস ও প্রত্যাশাই শরীরের ভেতরে বাস্তব শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটায়।

'Placebo' শব্দটি এসেছে ল্যাটিন "placere" থেকে, যার অর্থ,"আমি সন্তুষ্ট করব"। এই শব্দটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয় অকার্যকর বা নিষ্ক্রিয় পদার্থ বোঝাতে, যেটি আসলে রোগ সারানোর কোনো রাসায়নিক ক্ষমতা রাখে না, কিন্তু রোগীর মনে এক ধরনের বিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।১৯৫০-এর দশক থেকে মনোবিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞানে প্লাসিবো ইফেক্ট নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, আর আজ এটি মন ও শরীরের সংযোগের এক জীবন্ত প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত।

যখন কেউ বিশ্বাস করে যে সে কার্যকর কোনো চিকিৎসা নিচ্ছে, তখন সেই বিশ্বাস মস্তিষ্কে এক ধরনের জৈব প্রতিক্রিয়া শুরু করে।স্নায়ুবিজ্ঞানীরা একে বলেন "expectation-induced biochemical response"। মানে, প্রত্যাশার প্রভাবে শরীরের রাসায়নিক পরিবর্তন।
 

শরীরের ভেতরে যা ঘটে:

☞ এনডরফিন নিঃসরণ:এটি শরীরের স্বাভাবিক painkiller। মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত হয়ে ব্যথা, অস্বস্তি বা মানসিক চাপ কমায়।

☞ ডোপামিন ও সেরোটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধি:এই দুটি রাসায়নিক সুখ, আত্মবিশ্বাস ও প্রশান্তির অনুভূতি তৈরি করে। বিষণ্ণতা বা উদ্বেগে ভোগা রোগীরা তাই প্লাসিবো নিয়েও বাস্তব উন্নতি অনুভব করেন।

☞ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ও অ্যামিগডালার সক্রিয়তা:এগুলো সিদ্ধান্ত, আবেগ ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত মস্তিষ্কের অঞ্চল। এখানে কার্যকলাপ বাড়লে মানসিক স্থিতি আসে, ভয় কমে।
 

☞ ইমিউন সিস্টেমের সক্রিয়তা: বিশ্বাসের প্রভাবে শরীরে অ্যান্টিবডি উৎপাদন বাড়তে পারে,যা সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। অর্থাৎ, বিশ্বাস শরীরে বাস্তব "ফিজিওলজিক্যাল" পরিবর্তন ঘটায়, যা অনেক সময় চিকিৎসার মতোই কাজ করে।
 

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে,চিকিৎসা-বিজ্ঞানের গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে অনেক রোগী "নকল ওষুধ" খেয়েও ভালো হয়ে যাচ্ছেন।এটি যাচাই করতে শুরু হয় প্লাসিবো-কন্ট্রোলড ক্লিনিকাল ট্রায়াল (Placebo-Controlled Clinical Trial)।এই ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়:

একদলকে দেওয়া হয় আসল ওষুধ,অন্যদলকে দেওয়া হয় নকল কিন্তু দেখতে একেবারে একইরকম ওষুধ (Placebo)। যদি দ্বিতীয় দলেও উন্নতি দেখা যায়, তবে সেটিকে বলা হয় Placebo Response।

১৯৫৫ সালের প্রথম বড় গবেষণা- ড. হেনরি কে. বি (Henry Beecher) প্রকাশ করেন "The Powerful Placebo" নামের গবেষণাপত্র, যেখানে দেখানো হয় - প্রায় ৩৫% রোগী শুধুমাত্র প্লাসিবো গ্রহণ করেই বাস্তব উপসর্গের উন্নতি অনুভব করেন। তখন থেকেই এই ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা শুরু হয় চিকিৎসা-বিজ্ঞানে।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, প্লাসিবো ইফেক্ট হলো মন-শরীরের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া (Mind–Body Interaction)-এর সেরা উদাহরণ।
 

এখানে মূল ভূমিকা রাখে তিনটি মনস্তাত্ত্বিক উপাদান:

◑ Expectation (প্রত্যাশা):
রোগী বিশ্বাস করে যে সে ভালো হবে। এই বিশ্বাসই শরীরের প্রতিক্রিয়াকে সক্রিয় করে।
 

◑ Conditioning (অভ্যাসজাত প্রতিক্রিয়া):ওষুধ খাওয়ার সাথে ভালো লাগার অভিজ্ঞতা যুক্ত থাকলে, পরেরবার নকল ওষুধ খেলেও শরীর একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেয়।
 

◑ Motivation (প্রেরণা): "আমি সুস্থ হব" এই মানসিক অবস্থাই শরীরকে স্বনিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করতে বাধ্য করে।
 

fMRI ও PET স্ক্যানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্লাসিবো প্রয়োগের সময়:

Ventral Striatum ও Nucleus Accumbens সক্রিয় হয় (এগুলো 'পুরস্কার' ও 'প্রত্যাশা'-র কেন্দ্র)।

Anterior Cingulate Cortex (ACC) ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। Periaqueductal Gray (PAG) অঞ্চলে এনডরফিন নিঃসরণ বাড়ে, যা ব্যথা প্রশমনে কাজ করে।
এই সক্রিয়তাগুলো কোনো বাস্তব ওষুধ ছাড়াই ঘটে, কেবল বিশ্বাসের প্রভাবে।
 

প্লাসিবো ব্যবহারের সবচেয়ে বড় বিতর্ক হলো-
রোগীকে না জানিয়ে "নকল ওষুধ" দেওয়া নৈতিকভাবে সঠিক কি না!

এই প্রশ্নের সমাধান হিসেবে এসেছে নতুন এক পদ্ধতি - Open-Label Placebo। এখানে রোগীকে আগেই জানানো হয়:

এই ওষুধের কোনো রাসায়নিক প্রভাব নেই, তবে এটি আপনার মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করবে।বিস্ময়করভাবে, গবেষণায় দেখা গেছে রোগীরা এই অবস্থাতেও উন্নতি অনুভব করেছেন।অর্থাৎ, "বিশ্বাসের জোর" কখনও "অজ্ঞানতার প্রতারণা"-র থেকেও শক্তিশালী।

আধুনিক ব্রেন ইমেজিং গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাসিবো ইফেক্ট চলাকালীন মস্তিষ্কে "reward circuitry" (পুরস্কার সম্পর্কিত স্নায়ুপথ) সক্রিয় হয়।এই সময় মস্তিষ্ক ভাবতে শুরু করে-"চিকিৎসা শুরু হয়েছে, আমি সুস্থ হব।"এই সাইকোলজিক্যাল প্রত্যাশা বাস্তবে শরীরের হরমোন, নিউরোট্রান্সমিটার ও ইমিউন প্রতিক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত চিকিৎসার মতোই কার্যকর হয়।অন্যভাবে বললে, মন শরীরের ভেতরে চিকিৎসা প্রক্রিয়া "সিমুলেট" করে, যেন এক ধরনের স্বনির্ভর চিকিৎসা।

 

সব ধরনের অসুস্থতায় প্লাসিবো ইফেক্ট সমান কার্যকর নয়।গবেষণায় দেখা গেছে-

মাথাব্যথা, অনিদ্রা, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, পারকিনসন ডিজিজের প্রাথমিক পর্যায়, এমনকি ইমিউন সিস্টেম দুর্বলতা, এগুলোতে প্লাসিবো ইফেক্ট দৃশ্যমানভাবে কাজ করে।কিন্তু সংক্রমণ, টিউমার, বা অঙ্গ-প্রতিস্থাপনজনিত শারীরিক সমস্যায় এর প্রভাব খুবই সীমিত। কারণ এসব ক্ষেত্রে রোগের মূল কারণ রাসায়নিক বা জৈবিক, যা শুধুমাত্র মস্তিষ্কের বিশ্বাস দিয়ে সারানো সম্ভব নয়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্লাসিবো শুধু গবেষণার অংশ নয়,এটি এখন মানব বিশ্বাস ও চিকিৎসা প্রতিক্রিয়ার একটি মানদণ্ড।ওষুধের কার্যকারিতা যাচাইয়ে বিজ্ঞানীরা "Placebo-Controlled Clinical Trial" ব্যবহার করেন। এই পরীক্ষায় একদল রোগীকে আসল ওষুধ, আরেক দলকে প্লাসিবো (অকার্যকর ওষুধ) দেওয়া হয় যাতে বোঝা যায়, প্রকৃত চিকিৎসা কতটা কার্যকর এবং কতটা কেবল মানসিক প্রতিক্রিয়া।

প্লাসিবো ইফেক্ট আসলে আমাদের শেখায়, মানুষের মন ও শরীর একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।যখন আমরা বিশ্বাস করি যে কিছু আমাদের ভালো করবে, সেই বিশ্বাসই শরীরে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যা বাস্তব পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা একে বলেন-"Belief is biology in motion" অর্থাৎ, বিশ্বাসও এক ধরনের জৈব প্রক্রিয়া।

প্লাসিবো ইফেক্ট আমাদের মনে করিয়ে দেয়-মানব শরীর কেবল রাসায়নিক নয়, এটি চিন্তা, অনুভূতি ও বিশ্বাসের জৈব প্রতিক্রিয়ার সমষ্টি। শরীরের প্রতিটি সাড়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে মন। আর মনের বিশ্বাস কখনও কখনও সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধের মতো কাজ করতে পারে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ