মহাকাশে রেডিয়েশন আক্রমণ! বিজ্ঞানীদের 'স্মার্ট স্যুট' কি পারবে মানুষকে রক্ষা করতে?

মহাকাশে রেডিয়েশন আক্রমণ! বিজ্ঞানীদের 'স্মার্ট স্যুট' কি পারবে মানুষকে রক্ষা করতে?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মহাকাশে মানুষের বসতি গড়ার স্বপ্ন এখন আর কেবল সায়েন্স ফিকশন নয় বরং বাস্তব গবেষণার এক দৌড়। তবে এই স্বপ্নের সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে এক অদৃশ্য শত্রু-কসমিক রেডিয়েশন।এটি এমন এক ধরনের বিকিরণ যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল সহজেই প্রতিরোধ করে, কিন্তু মহাকাশে, চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে পৌঁছালে এর আঘাত সরাসরি মানবদেহে লাগে। আর তাই, বিজ্ঞানীরা এখন একে মোকাবিলায় তৈরি করছেন উদ্ভাবনী কৃত্রিম চৌম্বক ঢাল, ন্যানো-মেটেরিয়াল শিল্ড, জেনেটিক প্রতিরোধী কোষ এবং বুদ্ধিমান স্যুট- যেগুলো মানব সভ্যতার পরবর্তী মহাকাশ অধ্যায়ের ভিত্তি হতে পারে।

কসমিক রেডিয়েশন কী এবং এটি এত বিপজ্জনক কেন?

"Cosmic Rays" বা কসমিক রেডিয়েশন হলো উচ্চশক্তিসম্পন্ন subatomic particles (প্রোটন, নিউট্রন, হেলিয়াম নিউক্লিয়াস, ইত্যাদি), যেগুলো মহাবিশ্বের গভীর থেকে আলোর গতির কাছাকাছি বেগে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহে এসে আঘাত হানে। সূর্য থেকেও কিছু রেডিয়েশন আসে, যেগুলোকে বলা হয় Solar Particle Events (SPE), কিন্তু গ্যালাক্সির বাইরে থেকে আসা Galactic Cosmic Rays (GCR) আরও শক্তিশালী ও বিপজ্জনক।এই বিকিরণ মানবদেহে প্রবেশ করলে-

⇨ DNA ভেঙে দেয় বা মিউটেশন ঘটায়,

⇨ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়,

⇨ নার্ভ সেল ক্ষতিগ্রস্ত করে,

⇨ এমনকি রক্তের মাধ্যমে কোষে আয়নাইজেশন ঘটিয়ে অঙ্গ বিকলতা তৈরি করে।
 

একটি মাত্র মহাকাশ মিশনের সময়, একজন নভোচারী পৃথিবীতে থেকে প্রায় ১০০০ গুণ বেশি বিকিরণ ডোজ পান। এ কারণেই পৃথিবীর বাইরে দীর্ঘ সময় থাকা মানে দেহের প্রতিটি কোষের উপর এক অবিরাম রেডিয়েশন বৃষ্টি।
 

মানবদেহে  প্রভাব: 

কসমিক রেডিয়েশন দেহের কোষে প্রবেশ করলে DNA strand break হয়। অর্থাৎ, জেনেটিক কোডের মূল কাঠামোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।ফলে শরীরের কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় ভুল হয়, যা ক্যান্সার, রেডিয়েশন সিকনেস, বা দ্রুত বার্ধক্য সৃষ্টি করে।গবেষণায় দেখা গেছে- মাত্র ৬ মাসের মহাকাশযাত্রা নভোচারীর সাদা রক্তকণিকার সংখ্যা ২০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। মস্তিষ্কের নিউরন ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেখা দেয় মেমোরি লস, মনোযোগের ঘাটতি ও আবেগীয় অস্থিরতা। এছাড়া, হাড়ের টিস্যুতে বিকিরণ প্রবেশ করলে ক্যালসিয়াম হ্রাস পেয়ে অস্টিওপোরোসিসের মতো সমস্যা দেখা দেয়।

 

 

বিজ্ঞানীরা যেভাবে তৈরি করছেন প্রতিরক্ষা ঢাল

১️। পৃথিবীর মতোই একটি ক্ষুদ্র ম্যাগনেটোস্ফিয়ার তৈরি করার ধারণা এখন বাস্তব গবেষণায় পরিণত হয়েছে।এতে সুপারকন্ডাক্টর রিং বা প্লাজমা ফিল্ড দিয়ে মহাকাশযানের চারপাশে তৈরি করা হবে এক কৃত্রিম চৌম্বক ক্ষেত্র, যা বিকিরণকে প্রতিফলিত করবে। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে, একটিমাত্র ১০ টেসলা শক্তির সুপারকন্ডাক্টর কয়েল ৯০% পর্যন্ত কসমিক রে প্রতিরোধ করতে পারে। এই ধারণার ভিত্তিতে এখন তৈরি হচ্ছে "Mini-Magnetosphere" প্রযুক্তি।

 

২️। রেডিয়েশন প্রতিরোধে সাধারণ ধাতু যেমন অ্যালুমিনিয়াম বা সীসা ব্যবহার করা হলেও এগুলো ভারী ও মহাকাশে ব্যবহার অনুপযুক্ত। বিজ্ঞানীরা তাই এখন ব্যবহার করছেন Hydrogen-rich Nanocomposites। যেমন: পলিথিন, বোরন, বা কার্বন-ন্যানোটিউব মিশ্রিত হালকা পদার্থ।এগুলো রেডিয়েশন কণার সাথে সংঘর্ষে প্রোটন শোষণ করে আয়নাইজেশন কমায়,
ফলে কোষে বিকিরণের প্রভাব ৫০–৬০% পর্যন্ত হ্রাস পায়।

 

৩️। একটি নতুন ধারণা হলো "Bioactive Shielding Suit"। যেখানে নভোচারীর পোশাকেই বসানো থাকবে ন্যানোসেন্সর, বিকিরণ পরিমাপক, এবং স্ব-সংশোধনী জেল স্তর।এই স্যুট বিকিরণের উপস্থিতি টের পেলেই মাইক্রো-শিল্ড মডিউল সক্রিয় হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ঘনত্ব বাড়াবে।একই সঙ্গে, ত্বকের উপরে মাইক্রো ব্যারিয়ার জেল বিকিরণ শোষণ করে DNA মেরামতি এনজাইম মুক্ত করবে। এক কথায়, শরীরের উপর পরিধানযোগ্য বুদ্ধিমান ঢাল।

 

৪️।  অত্যাধুনিক বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণা করছেন এমন জিন সম্পাদনা (Gene Editing) প্রযুক্তি নিয়ে, যা মানব কোষের মধ্যে বিকিরণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু জীবাণু যেমন Deinococcus radiodurans বা Tardigrade-এর DNA বিকিরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।তাদের DNA মেরামত জিন (DNA Repair Genes) এখন মানুষের কোষে স্থানান্তরের গবেষণা চলছে। এর ফলে, ভবিষ্যতের নভোচারীরা হয়তো হবেন জৈবিকভাবে উন্নত বিকিরণ-প্রতিরোধী মানুষ।
 

৫️। পানি কসমিক রে প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।
মঙ্গল মিশনের জন্য প্রস্তাবিত "Hydro-Shelter Habitat" ধারণায় নভোচারীদের বাসস্থান হবে এমন কাঠামোয় যেখানে দেয়ালের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত থাকবে পানি।এটি বিকিরণ শোষণ করে ভিতরের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।এভাবে পানি হবে একযোগে শিল্ড, জীবনধারক এবং বিকিরণ প্রতিরোধক।

 

এই গবেষণার ফল কেবল মহাকাশেই নয়,পৃথিবীতেও কাজে আসছে-

⇨ ক্যান্সার রেডিওথেরাপি রুমের নতুন শিল্ড ডিজাইন

⇨ নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট সুরক্ষা উপকরণে ন্যানো-পলিমার ব্যবহারে

⇨ বিমান চালকদের রেডিয়েশন প্রতিরোধ পোশাকে
 

অর্থাৎ, মহাকাশের বিপদ ঠেকাতে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি এখন মানবজাতির দৈনন্দিন নিরাপত্তার অংশ হয়ে উঠছে।

 

সীমাবদ্ধতা-

যদিও এসব প্রযুক্তি আশার আলো দেখাচ্ছে, তবুও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে-

⇨ চৌম্বক ঢালের জন্য শক্তিশালী বিদ্যুৎ উৎস প্রয়োজন,

⇨ ন্যানো-মেটেরিয়ালের স্থায়িত্ব দীর্ঘমেয়াদে অনিশ্চিত,

⇨ জেনেটিক পরিবর্তনে নৈতিক প্রশ্ন ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি রয়েছে,

⇨ আর সবচেয়ে বড় সমস্যা, মহাকাশে ওজন ও শক্তি সীমাবদ্ধতা।
 

তবুও, প্রতিটি সফল পরীক্ষা আমাদের এক ধাপ এগিয়ে নিচ্ছে-মানবজাতিকে একদিন পৃথিবীর বাইরে টিকে থাকার যোগ্য করে তুলতে।

কসমিক রেডিয়েশনকে একসময় মনে করা হতো "মানবজাতির মহাকাশ বিজয়ের চূড়ান্ত প্রতিবন্ধকতা"। কিন্তু আজ সেটিই বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী চেতনায় পরিণত হয়েছে নতুন সম্ভাবনায়।হাইড্রোজেন-ন্যানো শিল্ড, বায়োপ্রোটেকটিভ জিন, আর চৌম্বক বলয়-সব মিলিয়ে এক নতুন বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে মানবসভ্যতা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ