ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে রাখা কিছু গাছ হতে পারে শিশু ও পোষা প্রাণীর জন্য নীরব হুমকি!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ঘরের বাতাস শুদ্ধ রাখা, মানসিক প্রশান্তি আনা বা সাজসজ্জার জন্য অনেকেই ঘরে রাখেন বিভিন্ন ইনডোর প্ল্যান্ট। কিন্তু আপনি কি জানেন, কিছু গাছের ভেতরে থাকা বিষাক্ত রস, পাতা বা ফুল শিশু কিংবা পোষা প্রাণীর (বিশেষ করে বিড়াল ও কুকুর) জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে! প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই সবুজ বন্ধুরাই কখনও কখনও হয়ে উঠতে পারে বিপদের উৎস, যা জানলে অনেক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।
কেন কিছু গাছ বিপজ্জনক হয়?
অনেক উদ্ভিদে থাকে প্রাকৃতিক রাসায়নিক যৌগ (যেমন ক্যালসিয়াম অক্সালেট, গ্লাইকোসাইড, স্যাপোনিন, অ্যালকালয়েড ইত্যাদি), যা মূলত কীটপতঙ্গ বা প্রাণীদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়। কিন্তু এই যৌগগুলো মানুষ বা প্রাণীর শরীরে গেলে দেখা দেয়-
⇨ বমি, ডায়রিয়া, জ্বালা বা শ্বাসকষ্ট,
⇨ ত্বকে ফুসকুড়ি, চোখ জ্বালাপোড়া এবং
⇨ কখনও অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ক্ষতিও হতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বেশি, কারণ তারা গাছের পাতা বা ফুল মুখে দেয়ার প্রবণতা রাখে। একইভাবে, বিড়াল বা কুকুরও পাতা চিবোতে ভালোবাসে,আর সেখানেই লুকিয়ে থাকে বিপদ।
বিপজ্জনক ইনডোর গাছগুলোর তালিকা ও তাদের ক্ষতিকর দিক
১️। ডাইফেনবাখিয়া (Dieffenbachia) / Dumb Cane): এই গাছের পাতায় থাকে ক্যালসিয়াম অক্সালেট ক্রিস্টাল, যা মুখ বা জিভে লেগে গেলে মারাত্মক জ্বালা ও ফোলাভাব হয়।শিশু খেলে জিভ ফুলে কথা বলা বন্ধ হতে পারে, তাই একে বলা হয় "Dumb Cane"।প্রাণীর ক্ষেত্রে মুখ ফুলে যাওয়া, লালা ঝরা ও গিলতে কষ্ট হয়।
২️। পিস লিলি (Peace Lily) : যদিও নাম শান্তির প্রতীক, কিন্তু এতে থাকা রাসায়নিক যৌগও ক্যালসিয়াম অক্সালেট সমৃদ্ধ। শিশুর মুখে গেলে জ্বালা, বমি বা গলায় জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে।বিড়ালের ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে বমি ও শ্বাসকষ্ট।
৩️। পথোস / মানি প্ল্যান্ট (Pothos / Money Plant): প্রায় সব ঘরেই দেখা যায় এই জনপ্রিয় গাছটি। কিন্তু এর পাতাও অল্প পরিমাণে বিষাক্ত। গিলে ফেললে মুখে জ্বালা, হালকা বমি বা গলায় ব্যথা হয়।প্রাণীদের জন্য এটি বিশেষভাবে ক্ষতিকর; দীর্ঘমেয়াদে কিডনি ক্ষতিও হতে পারে।
৪️। অ্যালোভেরা (Aloe Vera): ত্বক ও চুলের যত্নে উপকারী হলেও, এর পাতার জেল পোষা প্রাণীর শরীরে গেলে সমস্যা হয়।এতে থাকা স্যাপোনিনস ও অ্যানথ্রাকুইনোন যৌগ বিড়াল বা কুকুরের বমি, দুর্বলতা ও খাওয়ার অনিচ্ছা সৃষ্টি করে। তাই বাথরুমে বা নিচু টেবিলে রেখে দেওয়া উচিত নয়।
৫️। ফিলোডেনড্রন (Philodendron): এই গাছের পাতা দেখতে সুন্দর, কিন্তু এতে থাকা অক্সালেট যৌগ মুখে জ্বালা, ত্বকে ফুসকুড়ি ও পেটে ব্যথা সৃষ্টি করে।পোষা প্রাণীরা পাতা চিবালে তৎক্ষণাৎ মুখ ফুলে যায় এবং লালা ঝরে।
৬️। স্নেক প্ল্যান্ট (Snake Plant / Mother-in-law's Tongue): এই গাছটি ঘরের বায়ু পরিশোধনে কার্যকর হলেও এর পাতায় থাকা স্যাপোনিন যৌগ পোষা প্রাণীদের জন্য বিষাক্ত।চিবোলে বমি, পেট ফাঁপা ও অলসতা দেখা দেয়।
৭️। ওলিয়েন্ডার (Oleander): সবচেয়ে বিষাক্ত ইনডোর গাছগুলোর একটি। এর সব অংশেই থাকে কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড, যা হৃৎপিণ্ডের ছন্দ ব্যাহত করে। শিশু সামান্য খেলে বমি, মাথা ঘোরা, এমনকি হৃৎস্পন্দন বন্ধও হতে পারে। পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রেও এটি মারাত্মক প্রাণঘাতী।
৮️। ক্যালাডিয়াম (Caladium / Elephant Ear Plant): পাতায় রঙিন নকশা থাকলেও এতে থাকা বিষাক্ত স্যাপ গিলে ফেললে মুখ ও গলা ফুলে যায়। বিড়ালদের ক্ষেত্রে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় ও চোখ ফুলে যেতে পারে।
৯️। জিজি প্ল্যান্ট (ZZ Plant / Zamioculcas zamiifolia): এই ট্রেন্ডি ইনডোর গাছের পাতায়ও ক্যালসিয়াম অক্সালেট থাকে।স্পর্শে ত্বকে চুলকানি, আর মুখে গেলে বমি ও গলায় জ্বালা দেখা দেয়। তাই এটি শিশুর নাগালের বাইরে রাখাই নিরাপদ।
১০। লিলি পরিবারের অন্যান্য ফুল (Tiger Lily, Day Lily, Easter Lily ইত্যাদি): বিশেষ করে বিড়ালের জন্য অতি বিষাক্ত, পাতা বা ফুল সামান্য চিবোলেও কিডনি বিকল হতে পারে। কিছু প্রজাতি মানুষের জন্যও অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী।
বিপদ এড়ানোর জন্য করণীয়
গাছ রাখলে শিশুর নাগালের বাইরে উচ্চস্থানে রাখুন।পোষা প্রাণী থাকলে এমন গাছ বেছে নিন যেগুলো "Pet-safe plants" হিসেবে স্বীকৃত। যেমন, Areca Palm, Spider Plant, Bamboo Palm, Boston Fern ইত্যাদি। গাছের রস বা মাটি ছোঁয়ার পর হাত ধুয়ে ফেলুন।সন্দেহ হলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা পরামর্শ নিন, বিশেষ করে যদি শিশু বা প্রাণী বমি, মুখ ফুলে যাওয়া বা শ্বাসকষ্টে ভোগে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহস্থালি দুর্ঘটনার প্রায় ১০% ক্ষেত্রে কোনো না কোনো গাছ বা গাছের উপাদান জড়িত থাকে, বিশেষত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে।এ কারণেই এখন অনেক দেশ ইনডোর গাছ বিক্রিতে "toxicity labeling" চালু করেছে, যেন ক্রেতারা আগে থেকেই জানেন কোন গাছ নিরাপদ, আর কোনটি নয়।
গাছ ঘরের প্রাণ, কিন্তু প্রতিটি প্রাণেরই সীমা আছে। ঘরের সৌন্দর্যের জন্য আমরা যে গাছ রাখি, তা যেন অজান্তে প্রিয় সন্তান বা পোষা প্রাণীর ক্ষতির কারণ না হয়, এই সচেতনতাই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। নিরাপদ গাছ বেছে নিন, গাছের যত্ন নিন আর সবুজ থাকুক জীবন, কিন্তু বিষমুক্তভাবে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।