মাংসের জন্য হাতি হত্যার প্রমাণ মিলেছে গবেষণায়
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশে হাতি শিকার নিয়ে নতুন এক উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। এতদিন পর্যন্ত দাঁতের জন্য হাতি হত্যা হওয়ার তথ্যই মূলত পাওয়া যেত, তবে এবার দেখা দিয়েছে আরও ভয়াবহ প্রবণতা, মাংসের জন্য হাতি হত্যা। সম্প্রতি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনে গবেষক দল একটি হাতি হত্যার স্থানের সন্ধান পেয়েছে।
গবেষক দলটি এ বছরের এপ্রিল মাসে চার সদস্যের একটি অভিযানে বনের গভীরে গিয়ে একটি দীর্ঘ মাচা খুঁজে পায়, যেখানে শুকনো হাতির মাংস, হাড় ও চামড়া পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, একটি পূর্ণবয়স্ক হাতিকে হত্যা করে সেখানে মাংস শুকানো হচ্ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারাও সাম্প্রতিক সময়ে হাতি হত্যার এমন কয়েকটি ঘটনার কথা নিশ্চিত করেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, সাঙ্গু-মাতামুহুরী এখনো তুলনামূলক অক্ষত ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি বন হলেও, মাংসের জন্য হাতি শিকারের এই নতুন প্রবণতা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
গবেষক দলের এক সদস্য মন্তব্য করেন, বনটি এখনো হাতির প্রাকৃতিক আবাস হিসেবে টিকে থাকলেও মাংসের জন্য শিকার শুরু হওয়া একটি ভয়াবহ সংকেত। তাঁর মতে, নিহত হাতির হাড় ও দাঁত মিয়ানমারে পাচার হয়ে থাকতে পারে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত নয় বছরে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে ১১৪টি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ১৯টি এবং সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে ৭৫টি ঘটনায়। একই সময়ে শেরপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে আরও ৩২টি হাতি হত্যার শিকার হয়েছে। এই পরিসংখ্যান হাতি সংরক্ষণে আইন প্রয়োগের দুর্বলতা এবং পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব নির্দেশ করে।
২০১৯ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রকাশিত তথ্যে উল্লেখ করা হয়, মিয়ানমারেও নিয়মিত হাতি হত্যা হচ্ছে, বিশেষত মাংস, চামড়া ও দাঁতের জন্য। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সীমান্তবর্তী এলাকার পাচারচক্রগুলো দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ রেখে এসব অপরাধে সম্পৃক্ত থাকতে পারে।
হাতিবিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, “পার্বত্য অঞ্চলে হাতির মাংস খাওয়ার প্রচলনের কথা বহু বছর ধরেই শুনেছি, তবে এবার প্রথমবার সরাসরি প্রমাণ পাওয়া গেছে।” তাঁর মতে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে হাতির অবাধ চলাচল থাকায় পাচারচক্রের সহযোগিতায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলে মনে হয়।
২০১৬ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাত্র ২৬৮টি বন্য হাতি অবশিষ্ট রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাণিবিজ্ঞান সংস্থা (আইইউসিএন) ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে হাতিকে ‘মহাবিপদাপন্ন’ প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। দেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে হাতি হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ অপরাধের জন্য সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে বাস্তবায়নের অভাবেই আইনের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
পরিবেশবিদ ও প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, হাতি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। কিন্তু অরক্ষিত বনাঞ্চল, সীমান্তপাচার ও আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে এই মহামূল্যবান প্রজাতিটি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। তাঁরা হাতি সংরক্ষণে সীমান্ত-সমন্বিত নজরদারি, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও কঠোর আইন প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
তথ্যসূত্রঃ সাইন্স-বীআপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।