সুদানের গৃহযুদ্ধ: একসময়ের পরম মিত্রের বর্তমান ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র
- Author, ইমরান হোসেন
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
সুদানজুড়ে চলছে আধুনিক সময়ের অন্যতম ভয়াবহ এবং বিস্মৃত এক গৃহযুদ্ধ। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে ক্ষমতার দখলকে কেন্দ্র করে সুদানের সেনাবাহিনী (SAF) এবং আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-এর মধ্যে যে সংঘাতের সূচনা হয়েছিল, তা আজ দেশটিকে এক চরম মানবিক বিপর্যয় ও বিভক্তির দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস্তুচ্যুতি এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় সংকটে পরিণত করেছে।
ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভক্ত এক দেশ
মুলত এই সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছেন দুই সামরিক বাহীনির প্রধান। একদিকে আছেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান, যিনি সুদানের সেনাবাহিনী (SAF) এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের প্রধান। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে তিনি একাধারে সেনাপ্রধান ও দেশের কার্যত রাষ্ট্রপতির ভূমিকা পালন করছেন।
অন্যদিকে রয়েছেন মোহাম্মদ হামদান দাগালো, যিনি "হেমেদতি" নামে পরিচিত। তিনি আধা-সামরিক বাহিনী RSF-এর কমান্ডার। শুধু তাই নয় দেশের পশ্চিমাঞ্চলে একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি-সমতুল্য নেতা হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করেছেন।
যার ফলে বর্তমানে দেশটি কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। SAF রাজধানী খার্তুমসহ উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে, আর RSF দারফুরসহ পশ্চিমাঞ্চলে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। আর একারনে উভয় পক্ষই পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার লক্ষ্যে এক রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এল-ফাশেরের পতন ও গণহত্যা
সাম্প্রতিক সময়ে এই সংঘাত এক নতুন এবং ভয়াবহ মোড় নিয়েছে দারফুর অঞ্চলের শেষ সুরক্ষিত শহর এল-ফাশেরের পতনের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ ১৮ মাস অবরোধের পর অক্টোবরের শেষে RSF শহরটি দখল করে নেয়। এর পরপরই সেখানে চালানো হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা RSF-এর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন, গণহত্যা এবং ব্যাপক যৌন সহিংসতার অভিযোগ এনেছে। স্যাটেলাইট চিত্রে গণকবরের অস্তিত্ব এবং রাস্তায় রক্তের দাগের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা রুয়ান্ডা গণহত্যার ভয়াবহতাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের।
ক্ষমতা, সম্পদ এবং আন্তর্জাতিক শক্তির খেলা
এই যুদ্ধ কেবল সুদানের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং এটি একটি জটিল আন্তর্জাতিক প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, যেখানে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে লড়াইকে জিইয়ে রেখেছে।
SAF-এর সমর্থক: মিশর, সৌদি আরব, ইরান, রাশিয়া এবং তুরস্ক বিভিন্ন কৌশলগত কারণে জেনারেল বুরহানের সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। মিশর নীল নদের পানির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, অন্যদিকে সৌদি আরব ও ইরান লোহিত সাগরে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী। অন্যদিকে রাশিয়া তার ওয়াগনার গ্রুপের মাধ্যমে সুদানের সোনার খনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
RSF-এর সমর্থক: সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE), চাদ এবং লিবিয়ার একাংশ (খলিফা হাফতারের বাহিনী) হেমেদতির RSF-এর মূল সমর্থক। সুদানের সোনার খনি ও কৃষি জমির নিয়ন্ত্রণ এবং আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারই আমিরাতের মূল লক্ষ্য বলে মনে করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, UAE সরাসরি RSF-কে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে।
নিরপেক্ষ কিন্তু স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষ: চীন তার বিপুল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ রক্ষা করতে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ইউক্রেন ও গাজা সংকটে মনোযোগ থাকায় সুদানের বিষয়ে কার্যত নিষ্ক্রিয়।
ব্যর্থ শান্তি প্রচেষ্টা ও ভবিষ্যতের অশনিসংকেত
একসময় "আফ্রিকার রুটির ঝুড়ি" হিসেবে পরিচিত সুদান আজ রক্ত, ধ্বংস আর দুর্ভিক্ষের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিধাবিভক্ত নীতি এবং বহিরাগত শক্তিগুলোর সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে সুদানে শান্তি প্রতিষ্ঠার সকল প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন শান্তি আলোচনার নামে যা হচ্ছে, তা যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি দ্রুত কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে দেশটি সম্পূর্ণভাবে খণ্ডিত হয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, যার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।