জানতে চান, আপনি কতটা সৃজনশীল? এই সহজ বিশ্লেষণেই মিলবে উত্তর!

জানতে চান, আপনি কতটা সৃজনশীল? এই সহজ বিশ্লেষণেই মিলবে উত্তর!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

পড়াশোনায় গড়পড়তা, খেলাধুলায় মাঝারি তবু তার চোখে অন্যরকম এক ঝিলিক। প্রতিদিনের নিয়মে নয়, বরং জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের রঙে খুঁজে ফেরে নিজের ভাবনার দিগন্ত। হয়তো হাতে তুলি নেয়, বা কলম দিয়ে কল্পনাকে গেঁথে ফেলে কথায়। আমাদের চারপাশে এমন মানুষ অগণিত-যারা নিয়ম ভাঙতে চায়, চিন্তার পরিধি বাড়াতে চায়। তারাই একসময় সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়, আর গড়ে তোলে সৃষ্টিশীলতার জগৎ। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই সৃজনশীলতার উৎস কোথায়! এটা কি জিনে নির্ধারিত, নাকি মস্তিষ্কের কোনো গোপন খেলা!

গবেষকরা দেখেছেন, সৃষ্টিশীলতা আংশিকভাবে জিনগত। মানুষের জিনোমে এমন কিছু জিন আছে যেগুলো স্নায়ুকোষের সংযোগ, নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যক্রম এবং মস্তিষ্কের তথ্যপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এসব জিনের সমন্বয়ে কারো মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে "নতুন আইডিয়া" তৈরি করতে দ্রুত সাড়া দেয়।তবে এর মানে এই নয় যে, জিন থাকলেই সবাই শিল্পী বা উদ্ভাবক হবেন।পরিবেশ, অভিজ্ঞতা, সামাজিক সহায়তা এবং মানসিক উন্মুক্ততা—এই চারটি উপাদান সৃজনশীলতার প্রকাশে নির্ধারক ভূমিকা রাখে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, "Creativity is the child of both genes and environment."অর্থাৎ, সৃজনশীলতার বীজ জন্ম থেকেই থাকে, কিন্তু ফুল ফোটে পরিবেশের আলো-বাতাসে।

আমাদের মস্তিষ্কের দুটি দিক বা hemisphere আছে: বাম দিক যুক্তি ও বিশ্লেষণ সামলায়, আর ডান দিক কল্পনা ও সৃষ্টিশীল চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে।এই দুই অংশকে সংযুক্ত করে Corpus Callosum নামের স্নায়ুতন্তুর সেতু।

গবেষণায় দেখা গেছে-লেখক, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী বা উদ্ভাবকদের ক্ষেত্রে এই করপাস ক্যালোসাম তুলনামূলক ছোট, যা তথ্যপ্রবাহে ভিন্নধর্মী গতি তৈরি করে। এর ফলে একদিকে তারা গভীর বিশ্লেষণে সক্ষম হন, অন্যদিকে কল্পনাশক্তিরও অসাধারণ ব্যবহার করতে পারেন।এছাড়া Cerebellum বা ছোট মস্তিষ্কের কিছু অংশও সৃজনশীলতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এটি শুধু ভারসাম্য বা মোটর কন্ট্রোল নয়, বরং সঙ্গীত বা চিত্রকলায় "improvisation"-এর মুহূর্তগুলোয় সক্রিয় থাকে।আর মস্তিষ্কের Medial Prefrontal Cortex, Inferior Frontal Gyrus, এবং Temporal Association Area-এই অংশগুলো আইডিয়া তৈরি, রূপান্তর ও উপস্থাপনায় ভূমিকা রাখে। fMRI স্ক্যানের মাধ্যমে দেখা যায়, যখন কেউ কোনো নতুন ধারণা কল্পনা করে, তখন এই অংশগুলোতে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়-মানে, মস্তিষ্ক তখন সৃষ্টিশীলভাবে কাজ করছে।

 

মনোবিজ্ঞানীরা সৃজনশীলতাকে শুধু প্রতিভা নয়, বরং "এক ধরণের মানসিক অবস্থা" হিসেবে বর্ণনা করেন।
এ অবস্থায় মস্তিষ্কে ঘটে "ডাইভারজেন্ট থিংকিং",অর্থাৎ একটি সমস্যার একাধিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা। এই ভাবনা প্রক্রিয়াই মানুষকে ভিন্নভাবে দেখতে শেখায়, যেখানে সীমাবদ্ধতা নয়, বরং সম্ভাবনাই মুখ্য।সৃজনশীল মানুষদের মস্তিষ্কে "default mode network" বেশি সক্রিয় থাকে,যা বিশ্রামের সময়ও চিন্তা চালিয়ে যায়।তারা প্রায়ই মনোসংযোগ হারিয়ে স্বপ্ন দেখার মতো ভাবনায় ডুবে যান, কিন্তু ঠিক সেই ভাবনার মধ্যেই জন্ম নেয় নতুন ধারণা।এই কারণেই অনেকে বলেন,সৃষ্টিশীলতা শুরু হয় তখনই, যখন মস্তিষ্ক বিশ্রামে থাকে, কিন্তু মন কাজ করে নিরন্তর।
 

মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় সৃজনশীল ব্যক্তিদের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য দেখা যায়-

⇨ ওপেননেস টু এক্সপেরিয়েন্স:তারা নতুন অভিজ্ঞতা নিতে ভয় পান না। অচেনা বিষয় তাদের আকৃষ্ট করে।

⇨ পারসিস্টেন্স বা অধ্যবসায়: ব্যর্থতা তাদের থামায় না; বরং আরও শেখার তাগিদ দেয়।

⇨ ইন্টেনস এমোশনাল রেসপন্স:তারা সাধারণের চেয়ে অনুভব করেন গভীরভাবে। একটি রঙ, সুর বা ভাবনাও তাদের মানসে আলোড়ন তোলে।

⇨ নিরন্তর কৌতূহল: "কেন?" প্রশ্নটা তাদের জীবনের ধ্রুবক। তারা সবকিছু জানার ও বোঝার চেষ্টা করেন।

⇨ অনিশ্চয়তার সঙ্গে সহাবস্থান:নতুন কিছু করতে গেলে ফল অনিশ্চিত থাকে। সৃজনশীলরা এই অনিশ্চয়তাকে ভয় না পেয়ে সঙ্গী করে নেন।
 

সৃষ্টিশীলতার উত্থান অনেক সময় ঘটে অবচেতন বা সংকটময় মুহূর্তে।কিছু মানুষের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ, গভীর দুঃখ বা শারীরিক দুর্ঘটনা নতুন চিন্তার পথ খুলে দেয়।বৈজ্ঞানিকভাবে যাকে বলা হয় Acquired Savant Syndrome,যেখানে মস্তিষ্কে আঘাতের পর অজানা এক প্রতিভা বিকশিত হয়।এমন এক ঘটনায় মার্কিন নাগরিক ডেরেক আমাতো মাথায় আঘাতের পর হঠাৎই পিয়ানো বাজানোর অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেন,যা আগে কখনো শেখেননি।এ ধরনের ঘটনা দেখায়, মস্তিষ্কের কিছু অংশ নিষ্ক্রিয় থাকলেও, অন্য অংশ সক্রিয় হয়ে নতুন দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারে।

অনেক সময় সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে যুক্ত হয় "নিউরোটিসিজম",অর্থাৎ অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, মুড পরিবর্তন, উদ্বেগ ও গভীর চিন্তার প্রবণতা।
এটি কোনো মানসিক রোগ নয়, বরং মানসিক অতিসচেতনতার লক্ষণ।

ইতিহাসে দেখা যায়, আইজ্যাক নিউটন, চার্লস ডারউইন কিংবা ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ-সবার মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য প্রবল ছিল।অতিরিক্ত চিন্তা ও মানসিক চাপ তাদের ভেতর সৃজনশীল শক্তি জাগিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে তাদের মানসিক ক্লান্তিও বাড়িয়েছে।তবে সব সৃষ্টিশীল মানুষই এমন নন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো ব্যক্তিত্বরা শান্ত, সংযত ও ভারসাম্যপূর্ণ থেকেও ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শিল্পী ও চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, সৃজনশীলতা চর্চা করা যায়।নিয়মিত বই পড়া, নতুন মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়, প্রকৃতির পর্যবেক্ষণ, কিংবা সঙ্গীত-চর্চা সবই মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশন বাড়ায়।

মনোবিজ্ঞানীরা "Creativity Training"-এর কথা বলেন, যেখানে মাইন্ড ম্যাপিং, ব্রেনস্টর্মিং, ভিজুয়ালাইজেশন বা "what if"-ধরনের প্রশ্ন মস্তিষ্ককে উদ্ভাবনীভাবে ভাবতে শেখায়।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-নিজেকে প্রশ্ন করা, ব্যর্থতাকে ভয় না পাওয়া, আর মনকে নতুন চিন্তার জন্য উন্মুক্ত রাখা।

সৃষ্টিশীলতা কোনো নির্দিষ্ট প্রতিভার নাম নয়; এটি এক মানসিক যাত্রা।কেউ সেই যাত্রা শুরু করেন সুরে, কেউ রঙে, কেউ বা চিন্তার ভাষায়।
বিজ্ঞান বলে, প্রত্যেকের মধ্যেই সৃজনশীলতার বীজ আছে, শুধু দরকার অনুপ্রেরণা, প্রশিক্ষণ ও সাহস। হয়তো আপনি নিজেকে সাধারণ ভাবেন, কিন্তু আপনার মস্তিষ্কের গভীরে ঘুমিয়ে আছে কোনো এক অনন্য প্রতিভা, যা জেগে উঠলেই আপনি বদলে দিতে পারেন আপনার পৃথিবীকে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ