বই পড়া কি বিলুপ্তির পথে? চ্যাটজিপিটি এবং আমাদের গভীর চিন্তার সংকট!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
এক সময় ছিল, সন্ধ্যায় হাতে বই নিয়ে সময় কাটানো ছিল সবচেয়ে শান্ত মুহূর্তগুলোর একটি। এখন সেই জায়গায় এসেছে কীবোর্ড, সার্চ বার, আর "চ্যাটজিপিটি"। এক ক্লিকে পাওয়া উত্তর যেন বইয়ের পাতার জায়গা দখল করে ফেলেছে।
চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন শুধু প্রযুক্তি নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। স্কুলের প্রজেক্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, এমনকি লেখালেখি, সব জায়গাতেই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে AI।
তথ্য পেতে এখন আর বই ঘাঁটতে হয় না; প্রশ্ন করলেই সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর হাজির।তবে এখানেই সূক্ষ্ম এক পার্থক্য-জানার গতি বাড়ছে, কিন্তু বোঝার গভীরতা কমছে। AI আমাদের তথ্য দিচ্ছে "রেডিমেড" আকারে; কিন্তু বই শেখায় চিন্তা করতে, বিশ্লেষণ করতে, এবং মত গঠন করতে। বই পড়া মানে চিন্তার এক প্রক্রিয়া, যেখানে পাঠক ধীরে ধীরে শব্দ, বাক্য, ধারণার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে। অন্যদিকে চ্যাটজিপিটি আমাদের দেয় প্রস্তুত বিশ্লেষণ, যা চিন্তার পরিশ্রমকে কমিয়ে দেয়।
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা একে বলেন "ডিপ কগনিটিভ প্রসেসিং", অর্থাৎ বই পড়ার সময় মস্তিষ্ক ধীরে, কিন্তু গভীরভাবে তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে।
এর ফলে গড়ে ওঠে নিউরাল নেটওয়ার্ক, যা দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি, বিশ্লেষণক্ষমতা এবং মনোযোগের স্থায়িত্ব বাড়ায়।এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত বই পড়েন, তাদের "গ্রে ম্যাটার" ঘনত্ব বেশি থাকে,যা সৃজনশীলতা ও ভাষা বোঝার ক্ষমতা বাড়ায়।অন্যদিকে যারা মূলত স্ক্রিনভিত্তিক দ্রুত তথ্যের উপর নির্ভরশীল, তাদের মস্তিষ্কে "সারফেস প্রসেসিং" বেশি হয়, যা ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি তৈরি করে।
বই পড়ার অভ্যাস কেবল জ্ঞানার্জনের নয়, এটি এক ধরনের "মানসিক ব্যায়াম"। যখন কেউ গল্পের জগতে ডুবে যায়, তখন মস্তিষ্কে নিঃসৃত হয় ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন, যেগুলো প্রশান্তি ও মনোযোগ বাড়ায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বই পড়া মানুষকে "মনোযোগী ও আবেগ-সচেতন" করে তোলে।অন্যদিকে, চ্যাটজিপিটি বা সামাজিক মাধ্যম নির্ভর পড়াশোনায় মনোযোগের স্থায়িত্ব কমে যায়, কারণ মস্তিষ্ক সেখানে "দ্রুত পুরস্কার" (Instant Reward) খোঁজে।ফলে বই না পড়ার ফলে শুধু জ্ঞান নয়, মনোযোগ, ধৈর্য ও সৃজনশীলতাও কমে যাচ্ছে।
তথ্যের আধিক্য আমাদের যুগের বাস্তবতা।একদিকে AI তৈরি করছে তথ্যের "সুনামি", অন্যদিকে মানুষের মনোজগত ক্রমেই অভ্যস্ত হচ্ছে সংক্ষিপ্ততায়।
আজকের প্রজন্ম ৬০ সেকেন্ডের ভিডিও বা এক লাইনের সারসংক্ষেপে অভ্যস্ত। সামাজিক মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, "দ্রুত জানার সংস্কৃতি" (Fast Knowledge Culture) আসলে আমাদের চিন্তার কাঠামোকেই বদলে দিচ্ছে।
বইয়ের গভীরতা যেখানে সময় দাবি করে, AI সেখানে তাৎক্ষণিক উত্তরের আশ্বাস দেয়। ফলে জ্ঞান হচ্ছে বেশি, প্রজ্ঞা হচ্ছে কম।
ইউনেস্কোর ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী,
বিশ্বজুড়ে ১৮–৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে বইপাঠের হার গত এক দশকে কমেছে ৫২%। একই সময়ে AI-ভিত্তিক কনটেন্ট ব্যবহারে বেড়েছে ২৭০%। তবে আশার খবর হলো যারা এখনো বই পড়েন, তারা অন্যদের তুলনায়
৩ গুণ বেশি মনোযোগী,
২ গুণ বেশি সৃজনশীল,
এবং মানসিকভাবে ৪০% বেশি স্থিতিশীল।
অর্থাৎ বই এখন হয়তো কম পড়া হচ্ছে, কিন্তু যারা পড়ছেন, তাদের মানসিক ও জ্ঞানগত উন্নতি বহুগুণে বেশি।
চ্যাটজিপিটি এবং বই, এই দুই আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং দুই ভিন্ন শিক্ষামাধ্যম। AI হলো "তথ্যের সরবরাহকারী", আর বই হলো "চিন্তার নির্মাতা"। একটি শেখায় কীভাবে জানতে হয়, আর অন্যটি শেখায় কীভাবে ভাবতে হয়।অর্থাৎ, ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ দুটো একসাথে ব্যবহার করলে মানব মস্তিষ্ক আরও শক্তিশালী হতে পারে। AI তথ্য দেবে, বই সেই তথ্যকে অর্থ দেবে।
পাঠাভ্যাস টিকিয়ে রাখার উপায়
☞ প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
☞ ফোন দূরে রেখে ২০ মিনিট "নিঃশব্দ পাঠ" করুন।
☞ বই শুনুন-অডিওবুক বা ই-বুকও কার্যকর।
☞ পড়া বিষয় নিয়ে নোট লিখুন বা আলোচনা করুন।
☞ সপ্তাহে অন্তত একদিন "ডিজিটাল ডিটক্স" করুন।
চ্যাটজিপিটি আমাদের দ্রুত জ্ঞান দিচ্ছে, কিন্তু চিন্তার গভীরতা শেখাতে পারে না। বই হলো সেই আয়না, যেখানে আমরা নিজেদের ভাবি, সন্দেহ করি, এবং শেখি, যা কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করতে পারে না। তাই বলা যায়, বই হয়তো কম পড়া হচ্ছে, কিন্তু বিলুপ্ত হচ্ছে না।কারণ, মানুষের চিন্তা, অনুভব ও কল্পনার জগৎ এখনো বইয়ের পাতায়ই সবচেয়ে জীবন্ত।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।