হ্যাংরি হলে রাগ কেন হঠাৎ চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছায়? বিজ্ঞান জানাল রহস্য!

হ্যাংরি হলে রাগ কেন হঠাৎ চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছায়? বিজ্ঞান জানাল রহস্য!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আমরা অনেক সময়ই বলি,"পেট খালি থাকলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।" এই কথাটা শুনতে যতটা সাধারণ, বিজ্ঞানের চোখে তা আসলে গভীর এক মানসিক ও শারীরবৃত্তীয় সত্য। আজকের দ্রুতগতির জীবনে খাবার দেরিতে পাওয়া, উপোস থাকা বা কাজের চাপে খেতে ভুলে যাওয়া, এসব মুহূর্তেই আমরা অনুভব করি এক অদ্ভুত রাগ, খিটখিটে মেজাজ ও অস্থিরতা। এমন অবস্থাকে আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও নিউরোসায়েন্স বলছে"হ্যাংরি" (Hangry), অর্থাৎ hungry এবং angry দুই আবেগের সম্মিলন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে পেট খালি থাকা আমাদের আবেগকে এতটা পরিবর্তন করে! আসুন দেখি, এর পিছনের পুরো বিজ্ঞানটা কীভাবে কাজ করে।

আমাদের শরীর প্রতিটি মুহূর্তে শক্তি উৎপাদনের জন্য গ্লুকোজ ব্যবহার করে। এটি আসে মূলত খাবার থেকে, বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য থেকে। যখন দীর্ঘ সময় খাবার গ্রহণ করা হয় না, তখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমতে থাকে,এই অবস্থাকে বলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া।এই কম গ্লুকোজ অবস্থা প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের মস্তিষ্কে।যদিও শরীরের ওজনের মাত্র ২ শতাংশ মস্তিষ্ক, কিন্তু এটি শরীরের মোট শক্তির প্রায় ২০ শতাংশ ব্যবহার করে।তাই যখন রক্তে গ্লুকোজ কমে, মস্তিষ্ক সঙ্গে সঙ্গে সংকট অনুভব করে এবং "বেঁচে থাকার জন্য জরুরি ব্যবস্থা" নিতে শুরু করে।

ফলে মস্তিষ্কের prefrontal cortex অংশ, যা সিদ্ধান্ত নেওয়া, যুক্তি বিশ্লেষণ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের কাজ করে তখন কার্যক্ষমতা হারায়। তখন যুক্তির জায়গা দখল করে নেয় প্রতিক্রিয়া। এই অবস্থাতেই মানুষ অল্পতেই রেগে যায়, বিরক্ত হয়, বা হঠাৎ তর্কে জড়িয়ে পড়ে।

ক্ষুধার সময় শরীর কেবল শক্তি হারায় না, বরং একে "বিপদ সংকেত" হিসেবেও নেয়।তখন adrenal gland থেকে নিঃসৃত হয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন- অ্যাড্রেনালিন (Adrenaline) ও কর্টিসল (Cortisol)। এই হরমোন দু'টি আমাদের শরীরকে fight or flight mode-এ নিয়ে যায়, অর্থাৎ শরীর তখন মনে করে, বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হবে। হৃদস্পন্দন বাড়ে, রক্তচাপ বাড়ে, মনোযোগ কমে, এবং সামান্য ঘটনাতেও শরীর উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি রাগের জৈব রাসায়নিক ভিত্তি তৈরি করে। তাই ক্ষুধার সময় রাগ কেবল "মেজাজ খারাপ" নয়, এটি মূলত শরীরের বেঁচে থাকার সতর্ক প্রতিক্রিয়া।

আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, আমাদের পেট (gut) আর মস্তিষ্ক (brain) একে অপরের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে থাকে, যাকে বলে gut-brain axis।
এই অক্ষের মাধ্যমে পাকস্থলী মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়,"আমি খালি হয়ে গেছি।"এর জন্য দায়ী একটি হরমোন ঘ্রেলিন (Ghrelin)।যখন ঘ্রেলিনের মাত্রা বাড়ে, তখন তা মস্তিষ্কের amygdala ও hypothalamus অঞ্চলে প্রভাব ফেলে, যা মূলত রাগ, ভয় ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে।অর্থাৎ, ক্ষুধা লাগলে ঘ্রেলিন সরাসরি সেই অংশে কাজ করে, যেখান থেকে রাগের জন্ম হয়। ফলে ক্ষুধা ও রাগের মধ্যে তৈরি হয় এক নিখুঁত শারীরবৃত্তীয় সেতুবন্ধন।

PNAS (2014)-এর এক গবেষণায় ১০৭টি দম্পতির ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। দেখা যায়, যেসব ব্যক্তির রক্তে গ্লুকোজ কম ছিল, তারা সঙ্গীর প্রতি বেশি আক্রমণাত্মক আচরণ দেখিয়েছেন।এমনকি তারা রাগ প্রকাশে ছোটখাটো আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডেও বেশি যুক্ত হয়েছেন।Appetite Journal (2018)-এর গবেষণায় দেখা যায়, যারা দীর্ঘ সময় ক্ষুধার্ত থাকেন, তাদের মেজাজ, সহনশীলতা ও মনোযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। শরীর তখন আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, যার ফল রাগ ও বিরক্তি।Neuroscience & Biobehavioral Reviews (2021)-এর একটি বিশ্লেষণ দেখিয়েছে, ক্ষুধা কেবল আবেগ নয়, বরং সামাজিক আচরণেও প্রভাব ফেলে। ক্ষুধার সময় মানুষ কম সহমর্মী ও কম ধৈর্যশীল হয়ে পড়ে।

 

'হ্যাংরি' অবস্থা এড়াতে প্রথমেই দরকার নিয়মিত ও সুষম খাদ্যাভ্যাস। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি ৩–৪ ঘণ্টা পর পর অল্প কিছু খাওয়া গ্লুকোজের ভারসাম্য রক্ষা করে।

⇨ প্রোটিন (যেমন ডিম, ডাল, বাদাম) মস্তিষ্কে ধীরে ধীরে শক্তি সরবরাহ করে।

⇨ কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট (যেমন ওটস, ব্রাউন রাইস, শাকসবজি) দীর্ঘস্থায়ী শক্তি দেয়।

⇨ অতিরিক্ত ক্যাফেইন ও চিনি তাৎক্ষণিক শক্তি দিলেও পরে রক্তে গ্লুকোজ হঠাৎ কমে যায়। ফলে রাগ বেড়ে যেতে পারে।
 

তাই যাদের কাজের সময় দীর্ঘ বা মানসিক চাপ বেশি, তাদের জন্য ছোটখাটো স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস রাখা জরুরি। এটি শুধু ক্ষুধা নয়, মেজাজকেও নিয়ন্ত্রণে রাখে।

রাগ নয়, সংকেত হিসেবে ক্ষুধা চেনা!

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, রাগের সময় এক মুহূর্ত থেমে নিজেকে প্রশ্ন করুন-"আমি কি এখন সত্যিই রেগে গেছি, নাকি ক্ষুধার কারণে অস্থির?"এই ছোট প্রশ্নই আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।যদি উত্তর হয়-"আমি খাইনি"-তাহলে প্রথমেই পানি বা হালকা খাবার গ্রহণ করুন। শরীরের গ্লুকোজ বাড়লেই মস্তিষ্কে শান্তি ফিরে আসে, আর রাগও স্বাভাবিকভাবে কমে যায়।

'হ্যাংরি' আসলে কোনো মজার শব্দ নয়, এটি এক গভীর নিউরোকেমিক্যাল বাস্তবতা।ক্ষুধা আমাদের মস্তিষ্কে এমন সব প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যা রাগ, বিরক্তি ও অস্থিরতার আকারে প্রকাশ পায়।অর্থাৎ, আপনি যখন ক্ষুধায় রেগে যাচ্ছেন, তখন দোষটা আপনার মেজাজের নয় বরং আপনার শরীরের জ্বালানি সংকটের সতর্কবার্তা।তাই পরেরবার কেউ যদি ক্ষুধায় রেগে যায়, মনে রাখবেন, তার মস্তিষ্ক হয়তো তখন চিৎকার করছে,আমাকে শক্তি দাও, তাহলেই শান্ত হবো।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ