সৃজনশীলতার বিপ্লব নাকি প্রতারণা?এআই লেখকের বই ঘিরে বিশ্বজুড়ে নৈতিক তর্ক
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দীর্ঘ শতাব্দী ধরে "কলম" ছিল মানুষের আত্মার প্রতীক- চিন্তা, আবেগ, কল্পনা, ও মানবিক অভিজ্ঞতার একমাত্র বাহন। কিন্তু ২১শ শতকের এই ডিজিটাল যুগে কলম ধরা হাত বদলে গেছে। এখন সেই কলম ধরে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence)।হাজার বছরের সাহিত্য-ইতিহাসে এ এক অনন্য মুহূর্ত যখন মানুষ নয়, অ্যালগরিদম বই লিখছে, গল্প বলছে, কবিতা লিখছে, এমনকি দর্শনেরও ব্যাখ্যা দিচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি মানব ভাষার কাঠামো, আবেগের প্রকাশ, গল্পের ছন্দ, এমনকি চিন্তার তর্কধারা পর্যন্ত বিশ্লেষণ করতে পারে। বড় ভাষা মডেল (Large Language Models) যেমন ChatGPT, Claude, Gemini, LLaMA ইত্যাদি লক্ষ-কোটি বই, প্রবন্ধ, সংবাদ ও ওয়েবপেজ থেকে ভাষার প্রতিটি সূক্ষ্ম প্যাটার্ন শিখে নিয়েছে। ফলে আজ এআই এমনভাবে লেখে, যেখানে একটি বাক্যের গভীর মানে, টোন, ছন্দ ও আবেগ সবকিছুই মানুষের মতো মনে হয়।এমনকি অনেকে পার্থক্যই করতে পারেন না কোন লেখা মানুষ লিখেছে, আর কোনটি মেশিনের তৈরি।
২০২৩ সালের শেষ দিকে Amazon Kindle Direct Publishing (KDP)-এ এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে, মাত্র কয়েক মাসে প্রকাশিত হয় হাজারেরও বেশি এআই-লিখিত বই।এর মধ্যে ছিল শিশুদের গল্পের বই, রোমান্স উপন্যাস, মোটিভেশনাল গাইড, এমনকি ঐতিহাসিক উপন্যাসও। কিছু লেখক নিজের নামের পাশে উল্লেখ করলেন "Co-written with ChatGPT" আবার কেউ বললেন, "Written using AI assistance."কিন্তু অন্যদিকে অসংখ্য বই প্রকাশ পেল পুরোপুরি এআই-এর লেখা, অথচ কোনো প্রকাশক বা পাঠক জানলই না যে এর লেখক আসলে একজন "অ্যালগরিদম"। ফলস্বরূপ, মানব সৃষ্টিশীলতার জগতে প্রবেশ করল এক অচেনা প্রতিদ্বন্দ্বী, যার ক্লান্তি নেই, যার সময়ের সীমা নেই।
নৈতিক প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দু-"লেখক" মানে কে?
প্রথম প্রশ্নই আসে,এআই লেখকের বইয়ের প্রকৃত মালিক কে?
যদি একজন মানুষ এআই ব্যবহার করে বই লিখেন,তাহলে তিনি কি লেখক, নাকি কেবল নির্দেশদাতা?আর যদি সম্পূর্ণ বইটাই এআই লিখে ফেলে, তাহলে- একটি মেশিন কি লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে! ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কপিরাইট অফিস জানায়—"AI-generated texts cannot be copyrighted unless there is significant human creative involvement."অর্থাৎ, কেবল এআই-এর লেখা বই কপিরাইট সুরক্ষা পাবে না। কিন্তু মানব সহায়তায় তৈরি লেখা পেতে পারে। তবে বাস্তবের প্রশ্ন,মানুষের অবদান কতটুকু হলে সেটি "সৃজনশীল" ধরা হবে? এই সীমা আজও অনির্ধারিত।
এআই লিখতে পারে, কিন্তু সে ভাবতে পারে না। তার যা কিছু লেখা, তা তার শেখা ডেটার পুনর্গঠন মাত্র। অর্থাৎ, সে আসলে "নতুন কিছু" তৈরি করছে না, বরং শেখা শব্দের জগৎ থেকে নতুন বিন্যাস তৈরি করছে।
এআই লেখকের উত্থানে প্রকাশনা জগতে নেমে এসেছে এক বড় নৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন। অনেক নতুন লেখক অভিযোগ করছেন, প্রকাশকরা এখন দ্রুত বিক্রি হওয়ার মতো এআই-লিখিত বই প্রকাশ করছে, ফলে মানব লেখকদের সুযোগ কমে যাচ্ছে। অসংখ্য এআই বই বাজারে এলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গভীরতা, মৌলিক চিন্তা ও সাহিত্যিক মান অনুপস্থিত। পাঠক জানতেই পারেন না তারা যে বই পড়ছেন সেটি মানুষ লিখেছে, না মেশিন। এর ফলে সাহিত্যিক আস্থার জায়গাটিই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।
তবুও, একে একপাক্ষিকভাবে অস্বীকার করাও ঠিক নয়। এআই অনেক ক্ষেত্রে লেখকদের সহযোগী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে, গবেষণায় সাহায্য করছে, ব্যাকরণ ঠিক করছে, অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। যেমন: অনেক লেখক বলেন "AI gives me structure, but I give it soul."
অর্থাৎ, প্রযুক্তি যদি মানবিক সৃজনশীলতার সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলে, তবে এটি হতে পারে লেখালেখির এক নতুন রেনেসাঁসের সূচনা।
ভবিষ্যতের লেখালেখি হয়তো দাঁড়াবে এক নতুন সম্পর্কের ওপর যেখানে এআই হবে সহকারী, মানুষ হবে স্রষ্টা।মানুষ দেবে চিন্তার দিকনির্দেশনা,
এআই দেবে কাঠামো, গতি ও বিশ্লেষণ। এই সমন্বয়ে হয়তো সৃষ্টি হবে নতুন এক সাহিত্যধারা-"হাইব্রিড সাহিত্য",যেখানে প্রযুক্তি ও অনুভূতি মিশে যাবে একই কণ্ঠে।
মানুষের লেখা মানে ছিল আত্মার প্রকাশ, যন্ত্রের লেখা মানে তথ্যের পুনর্লিখন। আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেই সীমারেখায়,যেখানে প্রশ্নটা শুধু সাহিত্য নয়, মানবিক অস্তিত্বেরও। এআই হয়তো আমাদের শেখাবে দ্রুত লেখা, নিখুঁত ব্যাকরণ, আকর্ষণীয় গঠন। কিন্তু মানুষের কলমের ভেতরকার কাঁচা আবেগ, অনিশ্চয়তা, ভালোবাসা ও বেদনা সেটি এখনো কোনো যন্ত্রের ভাষায় অনুবাদ হয় না।তাই ভবিষ্যতের সাহিত্য যদি টিকে থাকতে চায়,তাকে হতে হবে প্রযুক্তির নয়, মানুষের হৃদয়ের।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।