মানুষ কেন সাহায্য করতে ভালোবাসে? জিনে লুকানো সেই অদ্ভুত রহস্য!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষের মধ্যে দয়া বা সহানুভূতির প্রবণতা কেবল নৈতিক শিক্ষা বা সামাজিক শিষ্টাচারের ফল নয়। এটি একটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, বিবর্তনগত কৌশল, যা আমাদের প্রজাতিকে হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। বর্তমানের মনোবিজ্ঞান, প্রজাতিবিদ্যা এবং স্নায়ুবিজ্ঞান এই আচরণের পেছনের জটিল জৈবিক ও সামাজিক যুক্তি তুলে ধরেছে।
মানবজাতির পূর্বপুরুষরা ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বাস করত। এই গোষ্ঠীগুলিতে টিকে থাকার মূল কৌশল ছিল সহযোগিতা ও সাহায্য করা। কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখা, খাবার ভাগাভাগি করা, বিপদে একে অপরকে রক্ষা করা- এই সবই সরাসরি জীবনের সম্ভাবনা বাড়াত। যারা এই ধরণের সহানুভূতিশীল আচরণ দেখাত, তারা টিকে থাকত এবং তাদের প্রজনন সফলতাও বেশি হতো। বিবর্তনবাদীরা এটিকে "সাধারণ অ্যাল্ট্রুইজম" এবং "সেলফিশ অ্যাল্ট্রুইজম" হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথমটি হলো প্রকৃতপক্ষে অন্যের কল্যাণের জন্য করা কাজ, যা দীর্ঘমেয়াদে নিজের বা গোষ্ঠীর উপকারও নিশ্চিত করে। অর্থাৎ, সহানুভূতি একটি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন স্বার্থপরতা।
মস্তিষ্কে দয়া ও সহানুভূতির আচরণ স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট অংশের সক্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে "অ্যামিগডালা" এবং "ভেন্ট্রাল স্ট্রিয়াটাম" অংশগুলো সাহায্য করার সময় সক্রিয় হয়। এই অংশগুলো সুখ, আনন্দ এবং পুরস্কারের অনুভূতি সৃষ্টি করে।গবেষকরা দেখেছেন, যখন মানুষ অন্যকে সাহায্য করে, তখন তারা প্রাকৃতিকভাবে 'সুখ হরমোন' ডোপামিন এবং অক্সিটোসিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা মনের শান্তি ও সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। এটি বোঝায় যে দয়া শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি জীবনের একটি প্রাকৃতিক 'ইনসেনটিভ', যা মানুষকে আরও সহযোগিতাপ্রবণ করে তোলে।
দয়া বা সহানুভূতির প্রবণতা কেবল মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রাইমেট, ডলফিন, হাথি, এমনকি কুকুরের মধ্যেও সহানুভূতির আচরণ লক্ষ্য করা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু প্রাইমেট দেখা গেছে বিপদে থাকা সদস্যকে রক্ষা করে, ক্ষতপ্রাপ্ত সদস্যকে দেখভাল করে, এমনকি খাবার ভাগ করে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এটি অসাধারণভাবে জটিল ও বহুমাত্রিক, কারণ আমরা শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক সাহায্য করি না, বরং দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক ও নৈতিক ফলাফলের জন্য পরিকল্পিতভাবে সহানুভূতি দেখাই।
দয়া কেবল ব্যক্তিগত বা জৈবিক মাত্রাই নয়; এটি সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত দয়া বা সহানুভূতিশীল কাজ করে, তাদের হার্টের স্বাস্থ্য, স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা, এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। এটি দেখায়, দয়া এবং সহযোগিতা আমাদের ব্যক্তিগত সুখ ও সামাজিক সুস্থতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
জিনগত দিক থেকেও মানুষের দয়া একটি 'বাঁচতে সাহায্যকারী জিনগত গুণ'। এমন আচরণ যারা পালন করত, তাদের জীবন ও প্রজনন সম্ভাবনা বেড়ে যেত। ফলে, প্রজন্মের পর প্রজন্মে এই আচরণ ছড়িয়ে পড়েছে। সহজভাবে বললে, দয়া মানুষের মধ্যে 'সামাজিক টিকে থাকার কৌশল' হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে।
আজকের সমাজে, প্রযুক্তি ও শহুরে জীবনের মাঝে দয়া আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটি কেবল সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যম নয়, বরং মানসিক চাপ কমানো, একাকিত্ব দূর করা, এবং সামাজিক সংহতি তৈরি করার একটি প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উপায়।
মানুষের দয়া করা বা সাহায্য করার প্রবণতা একটি বিবর্তনগত উপহার, যা আমাদের প্রজাতিকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে, মস্তিষ্কে আনন্দ জাগায়, এবং সামাজিক সম্পর্ক দৃঢ় করে। এটি কেবল নৈতিকতা নয়, এটি জীবনের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য ও মানসিক সুস্থতার একটি প্রাকৃতিক দান। মানুষের মধ্যের সহানুভূতি এবং দয়া প্রমাণ করে, যে মানবিকতা আমাদের জিনে লেখা, তা প্রাকৃতিক, যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে শক্তিশালী।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।