অ্যাসিডিটি শুধু খাবারের সমস্যা নয়, শরীরের ভেতর এক জটিল রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত!

অ্যাসিডিটি শুধু খাবারের সমস্যা নয়, শরীরের ভেতর এক জটিল রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

প্রতিদিনের জীবনে "অ্যাসিডিটি" শব্দটি শুনে আমরা ভাবি, সামান্য বুক জ্বালা বা টক ঢেকুর। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি কেবল খাবারজনিত নয়, বরং শরীরের হজম প্রক্রিয়া, স্নায়ুতন্ত্র, মানসিক চাপ, এমনকি ঘুমের ছন্দের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত একটি শারীরবৃত্তীয় সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিক গবেষণাগুলো বলছে, বিশ্বে প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে অন্তত একজন মানুষ নিয়মিত অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভোগেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে, বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এই হার আরও বেশি। কারণ, এখানকার খাবার ঝাল, তেলযুক্ত এবং অনিয়মিত খাবার সময়ের সংস্কৃতি এখনো সাধারণ অভ্যাস।

অ্যাসিডিটি আসলে কী?

আমাদের পাকস্থলীর ভেতরে থাকে এক ধরনের গ্রন্থি,যার নাম গ্যাস্ট্রিক গ্ল্যান্ড। এটি হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl) নিঃসরণ করে। এই অ্যাসিড খাবার ভেঙে ছোট অণুতে পরিণত করে, যাতে পুষ্টিগুণ সহজে শোষিত হয়।কিন্তু যখন অ্যাসিডের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে যায়, অথবা পাকস্থলীর মিউকাস প্রটেকটিভ লেয়ার দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনই এই অ্যাসিড খাদ্যনালী বা পাকস্থলীর দেওয়ালে প্রভাব ফেলে আর শুরু হয় বুক জ্বালা, ঢেকুর, টক ভাব, পেট ব্যথা, বমি ভাব বা কণ্ঠে খুসখুসে অনুভূতি।

 

 অ্যাসিডিটির মূল কারণসমূহ

১️। খাদ্যাভ্যাস ও খাওয়ার সময়সূচি: অনিয়মিত সময়ে খাবার খাওয়া, দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকা পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণ বাড়ায়।
অতিরিক্ত তেল, ঝাল, ভাজাভুজি, ফাস্টফুড, লাল মাংস, টমেটো বা কফি-এসব খাবারে থাকা অ্যাসিডিক উপাদান হজম প্রক্রিয়ায় অস্থিরতা আনে। খাবার শেষে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া বা ভারী খাবার খাওয়ার পর বসে থাকা অ্যাসিড রিফ্লাক্স বাড়ায়।
 

২️। মানসিক চাপ ও উদ্বেগ (Stress & Anxiety): মানসিক চাপ বাড়লে শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোন বৃদ্ধি পায়। এগুলো পাকস্থলীর স্নায়ু কার্যকলাপে প্রভাব ফেলে এবং অ্যাসিড নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এজন্যই অনেকেই বলেন—"রাগ বা চিন্তা করলেই বুক জ্বলে।"

 

৩️।  অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা: পেটের চারপাশে অতিরিক্ত চর্বি জমলে পাকস্থলীর উপর চাপ পড়ে। এতে অ্যাসিড খাদ্যনালীর দিকে উঠে আসে, যাকে বলে GERD (Gastroesophageal Reflux Disease)।

 

৪️। অ্যালকোহল, ধূমপান ও ক্যাফেইন: নিকোটিন খাদ্যনালীর নিম্নাংশের স্পিঙ্কটার পেশী দুর্বল করে, ফলে অ্যাসিড সহজে উপরে উঠে আসে। অ্যালকোহল পাকস্থলীর প্রোটেকটিভ মিউকাস স্তর ক্ষয় করে।
অতিরিক্ত কফি বা চা পাকস্থলীর pH ব্যালান্স নষ্ট করে।

 

৫️।  ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: দীর্ঘমেয়াদে NSAID (Painkiller) বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার পাকস্থলীর আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা অ্যাসিডিটির ঝুঁকি বাড়ায়।

 

লক্ষণ :

⇨ নিয়মিত বুক জ্বালা বা ঢেকুর
 

⇨ মুখে টক ভাব
 

⇨ বমি বমি ভাব বা গলায় জ্বালা
 

⇨ খাবার গিলতে কষ্ট
 

⇨ অজান্তেই ওজন কমে যাওয়া

 

এই উপসর্গ দীর্ঘদিন চললে গ্যাস্ট্রিক আলসার, ইসোফেজাইটিস বা ব্যারেটস ইসোফেগাস পর্যন্ত দেখা দিতে পারে, যা পরবর্তী পর্যায়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।


 

প্রতিরোধের উপায়:

প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ৫–৬ বারের ছোট খাবার খান।খুব গরম, অতিরিক্ত ঝাল বা টক জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত পানি নয়; বরং খাবারের ৩০ মিনিট পর পানি পান করুন। দই, কলা, ওটস, শসা, নারকেল পানি, সেদ্ধ সবজি—এসব খাবার পাকস্থলীর pH স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক।

 

জীবনযাপনের পরিবর্তন করুন। খাওয়ার পর অন্তত দুই ঘণ্টা পরে ঘুমান।
বিছানার মাথা ৬–৮ ইঞ্চি উঁচু করে ঘুমান। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।টাইট পোশাক পরা এড়িয়ে চলুন।

 

স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করার চেষ্টা করবেন। নিয়মিত ধ্যান, যোগব্যায়াম, প্রানায়াম বা হাঁটাহাঁটি শরীরের হরমোন ভারসাম্য ঠিক রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম অ্যাসিড নিঃসরণ প্রায় ৩০% পর্যন্ত কমাতে পারে।

 

অ্যাসিড কমাতে সাধারণত তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহৃত হয়—অ্যান্টাসিড (তাৎক্ষণিক আরাম দেয়), H2 ব্লকার (যেমন র্যানিটিডিন, ফ্যামোটিডিন), প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর (PPI) যেমন ওমিপ্রাজল, যা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিয়মিত ব্যবহার বিপজ্জনক। কারণ এতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি হতে পারে।


 

প্রাকৃতিক ঘরোয়া প্রতিকার:

⇨ গরম পানি ও মধু: হজমে সহায়তা করে এবং পাকস্থলীর মিউকাস স্তর মজবুত রাখে।
 

⇨ আদা: এতে থাকা জিঞ্জারল উপাদান অ্যাসিড নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
 

⇨ সামান্য তুলসি পাতা: প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি হিসেবে কাজ করে।
 

⇨ ঠান্ডা দুধ: ল্যাক্টোজ ও প্রোটিন পাকস্থলীর অ্যাসিডকে নিরপেক্ষ করে।
 

⇨ নারকেল পানি: এতে থাকা পটাশিয়াম শরীরের pH ভারসাম্য বজায় রাখে।

 

গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে- ইউরোপিয়ান জার্নাল অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি-র একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ রাতে মাত্র ৫ ঘণ্টা বা তার কম ঘুমান, তাদের মধ্যে অ্যাসিডিটির সমস্যা ৬০% বেশি।এছাড়াও, দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে বসে থাকা, দেরি করে রাতের খাবার খাওয়া এবং অতিরিক্ত কার্বনেটেড পানীয় সেবন অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়ায়।

 

অ্যাসিডিটি কোনো সামান্য সমস্যা নয়; এটি আমাদের শরীরের একটি সতর্কবার্তা, যা জানায় আমাদের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক স্বাস্থ্যে ভারসাম্য হারাচ্ছে।সামান্য সচেতনতা—সময়মতো খাবার, পরিমিত ঘুম, মানসিক প্রশান্তি ও প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস—এই চারটি অভ্যাসই পারে পাকস্থলীর অম্লের ঝড় থামাতে।

 

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ