চুল পড়া রোধ থেকে রক্তে শর্করা ও হৃদ্রোগ নিয়ন্ত্রণ,এই সাধারণ ফুলই স্বাস্থ্যকথার নতুন নায়ক
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলার আঙিনায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে জবা ফুলের রঙিন উপস্থিতি। কিন্তু এই পরিচিত ফুলটি যে একদিকে প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে, অন্যদিকে আধুনিক গবেষণায়ও বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে, তা অনেকেরই অজানা। Hibiscus rosa-sinensis, অর্থাৎ জবা ফুলের মধ্যে রয়েছে এমন কিছু জৈব রাসায়নিক যৌগ, যা শরীরের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
গবেষণায় দেখা যায়, জবা ফুলের পাপড়ি, পাতা ও কাণ্ডে উপস্থিত আছে-
☞ অ্যান্থোসায়ানিন (Anthocyanins),প্রাকৃতিক রঞ্জক, যা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
☞ ফ্ল্যাভোনয়েডস (Flavonoids), প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস প্রতিরোধে কার্যকর।
☞ ফেনোলিক যৌগ (Phenolic compounds), কোষের ক্ষয় রোধ করে ও বার্ধক্য ধীর করে।
☞ অর্গানিক অ্যাসিড (Citric, Malic, Tartaric acids), বিপাক প্রক্রিয়া উন্নত করে।
☞ ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম ও আয়রন, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও চুলের গঠন মজবুত রাখে।
এই উপাদানগুলো মিলেই জবা ফুলকে প্রাকৃতিক হেয়ার টনিক ও হারবাল ওষুধ হিসেবে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করেছে।
চুলের যত্নে -
প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদে জবা ফুল ও পাতার নির্যাসকে "কেশ্য রসায়ন" বলা হতো, যার অর্থ-চুল পুষ্ট ও সুরক্ষাকারী পদার্থ। জবা ফুলের নির্যাস চুলের ফলিকল (Follicle) কে শক্তিশালী করে, যা নতুন চুল গজাতে সহায়তা করে, এ ব্যাপারে আধুনিক ট্রাইকোলজিস্টরাও একমত। জবা ফুলের নির্যাস মাথার ত্বকে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়, ফলে চুলের গোড়ায় বেশি পুষ্টি পৌঁছে। এতে থাকা অ্যামিনো অ্যাসিড ও পেপটাইডস কেরাটিন উৎপাদন বাড়িয়ে চুলকে মজবুত করে। প্রাকৃতিক স্লাইম কন্টেন্ট চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে, ফলে চুল হয় মসৃণ ও উজ্জ্বল। নিয়মিত ব্যবহারে চুলের রুক্ষতা, খুশকি ও ভাঙন কমে যায়।
প্রয়োগ পদ্ধতি:
⇨ ৫–৬টি জবা ফুল ও কিছু পাতা বেটে নারকেল তেলের সঙ্গে গরম করে ঠান্ডা করুন।
⇨ সপ্তাহে ২ বার এই তেল চুলে লাগিয়ে ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
⇨ এটি প্রাকৃতিক হেয়ার কন্ডিশনার হিসেবেও কাজ করে।
হিবিসকাস চা: "Hibiscus sabdariffa" নামে পরিচিত এক প্রজাতির জবা ফুলের শুকনো পাপড়ি থেকে তৈরি চা এখন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
এই চায়ে রয়েছে প্রচুর অ্যান্থোসায়ানিন ও পলিফেনল, যা রক্তে গ্লুকোজ লেভেল ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
হিবিসকাস চায়ের উপাদানগুলো ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়িয়ে শরীরে শর্করা শোষণ প্রক্রিয়া উন্নত করে।এতে থাকা হাইড্রোক্সিসাইট্রিক অ্যাসিড চর্বি জমা প্রতিরোধে সাহায্য করে।নিয়মিত পান করলে এলডিএল কোলেস্টেরল কমায় এবং এইচডিএল কোলেস্টেরল বাড়ায়।
২০১৮ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১২ সপ্তাহ হিবিসকাস চা পান করলে টাইপ–২ ডায়াবেটিস রোগীদের ফাস্টিং ব্লাড সুগার গড়ে ১০–১২% পর্যন্ত কমেছে।
প্রস্তুত প্রণালী:
১. এক কাপ গরম পানিতে শুকনো জবা ফুলের ২–৩ গ্রাম যোগ করে ৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন।
২. ছেঁকে নিয়ে হালকা মধু যোগ করে পান করুন।
৩. প্রতিদিন এক থেকে দুই কাপ যথেষ্ট।
রক্তচাপ ও হৃদ্রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা-
জবা ফুলে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন ও ফেনোলিক যৌগ রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়। ফলে ভাসোডাইলেশন (Vasodilation) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসে। এছাড়া জবা ফুল ACE enzyme–এর কার্যকারিতা আংশিকভাবে দমন করে, যা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধেও ব্যবহার করা হয়।
একাধিক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, হিবিসকাস চা নিয়মিত পান করলে সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসার গড়ে ৭–১০ mmHg এবং ডায়াস্টোলিক প্রেসার ৪–৬ mmHg পর্যন্ত কমে।
হিবিসকাস ফুলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান লিভার সেল–এ জমে থাকা টক্সিন বা ফ্রি র্যাডিক্যাল কমায়।এর ফলে হেপাটিক এনজাইম (ALT, AST)–এর ভারসাম্য ঠিক থাকে।পাশাপাশি ফুলে থাকা ভিটামিন সি ও পলিফেনল শরীরের ইমিউন কোষ সক্রিয় রাখে, যা ভাইরাল সংক্রমণ ও প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
সতর্কতা ও সীমাবদ্ধতা:
গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী নারীদের নিয়মিত হিবিসকাস চা না খাওয়াই ভালো, কারণ এতে ইস্ট্রোজেন লেভেল প্রভাবিত হতে পারে। যাদের রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের ওষুধ চলছে, তারা প্রতিদিন হিবিসকাস চা খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন। অতিরিক্ত সেবনে মাথা ঘোরা বা হালকা বমি ভাব হতে পারে।
জবা ফুল শুধু একটি সৌন্দর্যবর্ধক গাছ নয়,এটি প্রকৃতির এক অসাধারণ ভেষজ ভান্ডার। চুলের যত্ন, ত্বক রক্ষা, রক্তচাপ ও রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ, এমনকি হৃদ্যন্ত্র ও লিভারের সুরক্ষাতেও এর ভূমিকা এখন প্রমাণিত।
বাংলার উঠোনে প্রতিদিন যে ফুলটি ফুটে, সেই জবা আসলে এক নিঃশব্দ চিকিৎসক, যার গুণাগুণের পরিধি আমাদের কল্পনার চেয়েও বিস্তৃত।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।