দেখতে মিল, বাস্তবে চমকপ্রদ বিপরীত! জানুন আর্কটিক ও অ্যান্টার্কটিকার অজানা সত্য
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দুনিয়ার দুই প্রান্তে উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু। বরফে ঢাকা, চরম ঠান্ডা, অন্ধকার শীত আর অনন্ত দিনের দেশ,দেখলে মনে হয় একরকম। কিন্তু , আর্কটিক (উত্তর মেরু) ও অ্যান্টার্কটিকা (দক্ষিণ মেরু) একে অপরের মতো নয়, বরং পৃথিবীর সবচেয়ে বৈপরীত্যপূর্ণ দুটি অঞ্চল।তাদের ভৌগোলিক গঠন, জলবায়ু, প্রাণীজগৎ, এমনকি বরফের প্রকৃতিও আলাদা। একদিকে সমুদ্রের উপর ভাসমান বরফের দেশ আর্কটিক, অন্যদিকে বিশাল মহাদেশীয় বরফের প্রাচীর অ্যান্টার্কটিকা। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই দুই মেরুর বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক পার্থক্যগুলো-
ভৌগোলিক গঠন: সমুদ্র বনাম মহাদেশ
আর্কটিক আসলে বরফে ঢাকা সমুদ্র, যা চারদিকে ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার উত্তর প্রান্তে ঘেরা। অর্থাৎ এটি একটি মেরু সমুদ্র (Polar Ocean), যার উপর ঘন বরফের স্তর ভাসে।
অন্যদিকে, অ্যান্টার্কটিকা একটি পূর্ণাঙ্গ মহাদেশ, যা প্রায় সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা। বরফের নিচে লুকিয়ে আছে পর্বত, আগ্নেয়গিরি, এমনকি হ্রদও। সেখানে মাটির পুরু বরফস্তর গড়ে উঠেছে প্রায় ১.৯ কিলোমিটার পুরুত্বে!তাই আর্কটিক "সমুদ্রের ওপর বরফ", আর অ্যান্টার্কটিকা "বরফের ওপর মহাদেশ"।
তাপমাত্রা ও জলবায়ু
আর্কটিকের তাপমাত্রা গড়ে শীতে –৩০°C, আর গ্রীষ্মে গড়ে ০°C-এর কাছাকাছি। সেখানে কখনও কিছু ঘাস, মস, আর ছোট গাছ জন্মায়।অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা স্থান। এখানে শীতে তাপমাত্রা নেমে যায় –৬০°C থেকে –৮৯°C পর্যন্ত। গ্রীষ্মকালেও গড় তাপমাত্রা থাকে –২৫°C। ফলে এখানে স্থায়ী উদ্ভিদ জন্মায় না, শুধু শৈবাল ও অণুজীব টিকে থাকে।
বরফের ধরন ও গলন
আর্কটিকের বরফ ভাসমান ও ঋতুভেদে পরিবর্তনশীল। গ্রীষ্মে এর অনেকটা গলে যায়, আবার শীতে পুনরায় জমে। অ্যান্টার্কটিকার বরফ মূলত স্থায়ী বরফচাদর (Ice Sheet), যা পৃথিবীর মোট বরফের ৬০% ধারণ করে। এ বরফ গলে গেলে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রায় ৬০ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন।
প্রাণীজগৎ:
দুই মেরুর প্রাণীরা একে অপরকে কখনও দেখে না।
আর্কটিকে বাস করে মেরুভালুক, আর্কটিক ফক্স, সিল, রেইনডিয়ার, ওয়ালরাস ইত্যাদি প্রাণী। তাদের জীবন নির্ভর করে সমুদ্রের বরফ ও মাছের ওপর।
আর অ্যান্টার্কটিকা হলো পেঙ্গুইনের রাজ্য। এখানে আছে এম্পেরর পেঙ্গুইন, অ্যাডেলি পেঙ্গুইন, এবং অসংখ্য সিল, তিমি, ও ক্রিল নামের ছোট প্ল্যাংকটনজাত প্রাণী।
মজার বিষয় হলো, মেরুভালুক ও পেঙ্গুইন কখনও একে অপরকে দেখে না! কারণ তারা থাকে দুই বিপরীত মেরুতে।
সূর্য, আলো ও অন্ধকারের বিপরীত ছন্দ!
দুই মেরুতেই সূর্য ওঠা-ডোবার সময় একেবারে আলাদা। আর্কটিকে একটানা ৬ মাস দিন (Midnight Sun) আর ৬ মাস রাত (Polar Night)।অ্যান্টার্কটিকাতেও একই ঘটনা ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। যখন উত্তর মেরুতে দিন, তখন দক্ষিণ মেরুতে রাত, এবং উল্টোটা।
বাতাস ও পরিবেশের প্রকৃতি-
অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক ও বায়ুবেগপ্রবণ অঞ্চল। এখানে বাতাসের গতি ঘণ্টায় ২০০ কিমি পর্যন্ত পৌঁছায়, তাই একে বলা হয় "the windiest continent on Earth"।আর্কটিকের জলবায়ু তুলনামূলকভাবে নরম; সমুদ্রের প্রভাবে তাপমাত্রার পার্থক্য কিছুটা নিয়ন্ত্রিত থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-
আর্কটিক দ্রুত গলছে। সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ৪০ বছরে আর্কটিক সাগরের বরফ প্রায় ৪০% কমেছে। ফলাফল হিসেবে সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়ছে, আবহাওয়া অস্থিতিশীল হচ্ছে, আর মেরুভালুকসহ অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ছে।অন্যদিকে, অ্যান্টার্কটিকা এখনো তুলনামূলক স্থিতিশীল, তবে পশ্চিমাঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি ভবিষ্যতের বৈশ্বিক সমুদ্রস্তর বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
মানব কার্যকলাপ ও গবেষণা-
আর্কটিক অঞ্চলে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করে। ইনুইট ও সামি জাতিগোষ্ঠীসহ প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ সেখানে থাকে।অ্যান্টার্কটিকা হলো মানববসতিহীন মহাদেশ, যেখানে কেবল বিজ্ঞানীরা গবেষণার জন্য সাময়িকভাবে অবস্থান করেন। 'Antarctic Treaty' অনুসারে, এখানে কোনো দেশ স্থায়ী দখল বা সামরিক কার্যক্রম চালাতে পারে না।
দুই মেরু এক পৃথিবী, ভিন্ন বাস্তবতা!
যদিও আর্কটিক ও অ্যান্টার্কটিকা দুই মেরুতেই চরম ঠান্ডা ও বরফের আধিপত্য, তবুও তাদের প্রকৃতি, প্রাণীজগৎ, ভৌগোলিক গঠন, এমনকি জলবায়ুর চরিত্র, সবকিছুতেই বিস্ময়কর পার্থক্য। একদিকে সমুদ্রের উপর বরফের ভাসমান রাজ্য আর্কটিক, অন্যদিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম ও রহস্যময় মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা।এই দুই মেরু যেন পৃথিবীর আয়না,একটি অপরটির বিপরীত প্রতিবিম্ব, যা আমাদের দেখায় প্রকৃতির বহুমাত্রিক সৌন্দর্য ও ভারসাম্যের সূক্ষ্ম খেলা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।