স্মৃতিশক্তি বাড়াতে চান? স্পেসিং ইফেক্টের জাদু জানুন আজই
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
শিক্ষার জগতে আমরা প্রায়ই ভাবি, একনাগাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে পড়লে বিষয়টা মাথায় বেশি গেঁথে যাবে। কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলছে, বাস্তবতা তার ঠিক উল্টো। গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, একটানা মুখস্থের চেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শেখা (Spacing Effect) দীর্ঘমেয়াদে অনেক বেশি কার্যকর। অর্থাৎ, কম সময়ে বেশি শেখার চাইতে, সময় ভাগ করে শেখা মানেই শেখার গভীরতা ও স্থায়িত্ব বাড়ানো।
"স্পেসিং ইফেক্ট" আসলে কী?
'Spacing Effect' হলো এমন একটি মনোবৈজ্ঞানিক প্রভাব, যেখানে একই তথ্য বারবার শেখা হয় কিন্তু নির্দিষ্ট বিরতি রেখে। প্রথমে বিষয়টা শেখা হয়, কিছু সময় বিরতি দেওয়া হয়, তারপর আবার পুনরাবৃত্তি করা হয়। এই পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি (Long-term memory) সক্রিয় হয়, ফলে তথ্য সহজে ভুলে যাওয়া যায় না। এই ধারণার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় ১৯ শতকের শেষ দিকে জার্মান মনোবিজ্ঞানী হারমান এবিংহাউস (Hermann Ebbinghaus)–এর গবেষণায়। তিনি প্রথম দেখান যে, আমরা যা শিখি তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাই, কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে পুনরাবৃত্তি করলে সেই ভুলে যাওয়ার গতি নাটকীয়ভাবে কমে যায়।
মস্তিষ্ক যেভাবে তথ্য ধরে রাখে-
আমাদের মস্তিষ্ক একবারে প্রচুর তথ্য গ্রহণ করতে পারে না। নতুন শেখা তথ্য হিপোক্যাম্পাস নামের অংশে জমা হয়, কিন্তু তা স্থায়ী হয় না।
যখন কোনো বিষয় পুনরায় শেখা হয়, তখন মস্তিষ্ক তা আগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযোগ ঘটায়, যাকে বলে নিউরাল রিইনফোর্সমেন্ট। প্রতি বিরতির পর শেখা মানে মস্তিষ্কের জন্য একটি নতুন "সংকেত" বা রিমাইন্ডার, যা তথ্যকে স্থায়ী স্মৃতিতে স্থানান্তর করতে সাহায্য করে। এই কারণেই স্পেসড রিভিশন করলে স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী হয়, আর একটানা পড়লে দ্রুত মুছে যায়।
কেন সময় ভাগ করে শেখা টিকে বেশি?
⇨ ভুলে যাওয়ার প্রাকৃতিক চক্র কাজে লাগায়। মস্তিষ্ক যখন কিছুটা ভুলতে শুরু করে, ঠিক তখনই পুনরাবৃত্তি শেখাকে আরও শক্ত করে।
⇨ মনোযোগের স্থায়িত্ব বাড়ায়। বিরতি মানে মানসিক ক্লান্তি কমে, নতুন করে মনোযোগ ফেরে।
⇨ অর্থবোধক শেখা ঘটে। সময়ের ব্যবধান শিক্ষার্থীকে বিষয়টি ভাবতে ও বুঝতে সাহায্য করে।
⇨ মস্তিষ্কের সংযোগ গভীর হয়। সময়ের ব্যবধানে পুনরায় শেখা নিউরনগুলোর মধ্যে স্থায়ী সংযোগ তৈরি করে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে-
স্পেসিং ইফেক্টে শেখা তথ্য তিন গুণ বেশি সময় ধরে মনে থাকে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ও ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি–এর গবেষণায় দেখা যায়, পরীক্ষার্থীরা এক সপ্তাহ ব্যবধান রেখে শেখা বিষয় ৬০% বেশি মনে রাখতে সক্ষম হন। এমনকি ভাষা শেখা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রোগ্রামিং, কিংবা সঙ্গীত—সব ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতি কার্যকর।
যেভাবে "Spacing Effect" ব্যবহার করবেন:
☞ পড়া ভাগ করুন। বড় অধ্যায় ছোট ছোট অংশে ভাগ করুন।
☞ সময়সূচি তৈরি করুন।আজ শেখা বিষয়টি ১ দিন পর, ৩ দিন পর, ৭ দিন পর আবার পড়ুন (১–৩–৭ নিয়ম)।
☞ অ্যাকটিভ রিকল ব্যবহার করুন। শুধু পড়া নয়, চোখ বন্ধ করে মনে করে বলার চেষ্টা করুন।
☞ মিশ্র পুনরাবৃত্তি(Interleaving)-র অভ্যাস করুন। একসঙ্গে এক বিষয় নয়, ভিন্ন ভিন্ন বিষয় ঘুরিয়ে পড়ুন। এতে মস্তিষ্কে তুলনামূলক শেখা বৃদ্ধি পায়।
শিক্ষার ভবিষ্যৎ:
আজকের এআই-চালিত শিক্ষাপ্রযুক্তিতে "Spacing Effect"–এর ধারণা কাজে লাগানো হচ্ছে স্মার্ট লার্নিং অ্যাপে। যেমন-Anki, Duolingo, বা Quizlet–এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীর শেখার অভ্যাস বুঝে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনরাবৃত্তির সময় নির্ধারণ করে দেয়। এটি "Spaced Repetition Algorithm" নামে পরিচিত, যা প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য শেখাকে ব্যক্তিগত ও কার্যকর করে তোলে।
"একবারে মুখস্থ" নয়, বরং ছড়িয়ে শেখা মানেই টেকসই শেখা এই সত্যটাই তুলে ধরে "Spacing Effect"। এটি শুধু মুখস্থ বিদ্যা নয়, বরং চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণক্ষমতা গঠনে সহায়ক এক কার্যকর শিক্ষাপদ্ধতি। শেখা তাই এখন সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ নয়, বরং সময়কে ভাগ করে বোঝার এক শিল্প, যেখানে বিরতি মানে ভুলে যাওয়া নয়, বরং স্মৃতি পাকা করার সুযোগ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।