পিরিয়ডের সময় ব্যথা বা ভারী রক্তপাত? হতে পারে 'ফাইব্রয়েড'-এর নীরব সতর্কবার্তা!

পিরিয়ডের সময় ব্যথা বা ভারী রক্তপাত? হতে পারে 'ফাইব্রয়েড'-এর নীরব সতর্কবার্তা!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

গর্ভাশয় একটি নারীর দেহের অন্যতম জটিল অথচ সূক্ষ্ম অঙ্গ। এখানেই নতুন প্রাণের সূচনা হয়, কিন্তু কখনও কখনও এই পবিত্র জায়গাটিতেই গড়ে ওঠে এক নীরব শত্রু-ফাইব্রয়েড (Fibroid)। বাংলায় যাকে বলা হয় 'গর্ভাশয়ের টিউমার' বা 'গাঁট'। এটি সাধারণত ক্যান্সার নয়, তবু দেহে নানা জটিলতা তৈরি করে। বিশ্বজুড়ে প্রতি চারজন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এই সমস্যায় আক্রান্ত হন, অথচ অধিকাংশই জানতেও পারেন না।

ফাইব্রয়েড আসলে কী?

ফাইব্রয়েড হলো জরায়ুর পেশি ও তন্তুজাত কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, যা ধীরে ধীরে একটি গাঁটের রূপ নেয়। এটি এককভাবে হতে পারে, আবার কখনও একাধিক গাঁট একসাথে গড়ে ওঠে। আকারেও এর তারতম্য হয়, কেউ কেউ ক্ষুদ্র বীজের মতো ফাইব্রয়েড বহন করেন, আবার কারও ক্ষেত্রে সেটি আপেলের মতো বড় হতে পারে।ফাইব্রয়েডের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে এর প্রভাবও ভিন্ন হয়-

১। ইন্ট্রামিউরাল ফাইব্রয়েড: জরায়ুর দেয়ালের মধ্যে বৃদ্ধি পায়।

২। সাবমিউকোসাল ফাইব্রয়েড: জরায়ুর অভ্যন্তরীণ স্তরের দিকে গঠন হয়।

৩। সাবসেরোসাল ফাইব্রয়েড: জরায়ুর বাইরের অংশে বৃদ্ধি পায় এবং আশপাশের অঙ্গে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
 

এগুলো সাধারণত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে বৃদ্ধি পায়, যা নারীর প্রজনন বয়সে (২০ থেকে ৪৫ বছর) সবচেয়ে সক্রিয় থাকে।


 

কেন হয় ফাইব্রয়েড?

যদিও সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি, তবুও চিকিৎসা ও গবেষণার মাধ্যমে কিছু বিষয়কে ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে—

☞ হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা: ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন এই দুটি হরমোন জরায়ুর কোষকে বৃদ্ধি করে। এদের ভারসাম্য নষ্ট হলে গাঁট তৈরি হতে পারে।

☞ বংশগত প্রভাব: মায়ের বা বোনের ফাইব্রয়েড থাকলে একই সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

☞ স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন: ফ্যাট টিস্যু হরমোন উৎপাদন বাড়ায়, যা ফাইব্রয়েডের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।

☞ দেরিতে বিয়ে বা গর্ভধারণ না করা: দীর্ঘদিন মাসিক চক্র চালু থাকলে হরমোনের প্রভাব বেশি সময় ধরে থেকে যায়, ফলে ঝুঁকি বাড়ে।

☞ অতিরিক্ত স্ট্রেস ও খাদ্যাভ্যাস: চিনিযুক্ত, প্রক্রিয়াজাত খাবার, রেড মিট ও কম সবজি খাওয়ার প্রবণতা শরীরে প্রদাহ ও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে।

 

লক্ষণগুলো কীভাবে বুঝবেন?

ফাইব্রয়েড সবসময় লক্ষণ প্রকাশ করে না। অনেকেই বছর পর বছর ধরে এটি নিয়ে বেঁচে থাকেন, কিন্তু কোনো উপসর্গই অনুভব করেন না। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে যা উপেক্ষা করা উচিত নয়-

⇨ অতিরিক্ত বা দীর্ঘস্থায়ী মাসিক রক্তপাত

⇨ তলপেটে ভারী ভাব বা ফুলে থাকা অনুভব

⇨ প্রস্রাবের বেগ বৃদ্ধি বা মূত্রথলিতে চাপ অনুভব

⇨ পিঠে বা কোমরে ব্যথা

⇨ সহবাসের সময় ব্যথা

⇨ পেটের আকার বেড়ে যাওয়া

⇨ গর্ভধারণে সমস্যা বা গর্ভপাতের ঝুঁকি

এই উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে বাড়তে পারে, তাই অনেক সময় এগুলোকে নারীরা "স্বাভাবিক মাসিক সমস্যা" ভেবে উপেক্ষা করেন যা আসলে বিপজ্জনক হতে পারে।
 

কীভাবে শনাক্ত হয়?

ফাইব্রয়েড শনাক্ত করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হলো আল্ট্রাসনোগ্রাফি (Ultrasound)। কখনও MRI বা হরমোনাল রক্তপরীক্ষাও করা হয়, যাতে গাঁটের আকার, অবস্থান এবং প্রকৃতি জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নারীর জন্য অত্যন্ত জরুরি, কারণ ফাইব্রয়েডের অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান উপসর্গ থাকে না। আগে ধরা পড়লে চিকিৎসাও সহজ হয়।

 

ফাইব্রয়েডের জটিলতা

যদিও এটি বিনাইন (অর্থাৎ ক্যান্সার নয়), তবুও অবহেলা করলে ফাইব্রয়েড নানা শারীরিক জটিলতা তৈরি করতে পারে—

⇨ রক্তাল্পতা: অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়।

⇨ বন্ধ্যাত্ব: জরায়ুর আকার বিকৃত হলে নিষিক্ত ডিম্ব স্থাপন ব্যাহত হতে পারে।

⇨ গর্ভাবস্থার জটিলতা: গর্ভপাত, প্রি-ম্যাচিউর বার্থ বা সিজারিয়ান হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

⇨ প্রেসার ও ব্যথা: ফাইব্রয়েড বড় হলে আশপাশের অঙ্গে চাপ সৃষ্টি করে।
 

 

চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা

চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, গাঁটের আকার, অবস্থান ও উপসর্গের তীব্রতার উপর।

➤ ওষুধভিত্তিক চিকিৎসা: হরমোন নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ (যেমন GnRH agonist) ফাইব্রয়েডের বৃদ্ধি কমাতে সাহায্য করে, তবে এটি স্থায়ী সমাধান নয়।

◑ নন-সার্জিক্যাল পদ্ধতি: নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে জরায়ুর রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে ফাইব্রয়েডকে সংকুচিত করা যায়, যাকে বলে Uterine Artery Embolization (UAE)।

 

সার্জিক্যাল পদ্ধতি:

◑ মায়োমেকটমি (Myomectomy): শুধু ফাইব্রয়েড অপসারণ করা হয়, জরায়ু অক্ষত থাকে।

◑ হিস্টেরেকটমি (Hysterectomy): গুরুতর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ জরায়ু অপসারণ করা হয়।

 

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন:

◑ প্রক্রিয়াজাত খাবার ও লাল মাংস কমানো

◑ পর্যাপ্ত পানি পান ও সবুজ শাকসবজি খাওয়া

◑ নিয়মিত ব্যায়াম ও স্ট্রেস কমানো

◑ শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা

 

সতর্কবার্তা: 

ফাইব্রয়েড একেবারে নিঃশব্দে বেড়ে ওঠে। অনেক নারী কেবল গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দিলে প্রথমবার জানতে পারেন যে, তাদের গর্ভাশয়ে গাঁট আছে। এ কারণে চিকিৎসকরা নিয়মিত গাইনোকলজিক চেকআপ ও আল্ট্রাসনো টেস্ট করার পরামর্শ দেন, বিশেষ করে যদি আপনার বয়স ৩০ এর বেশি হয় এবং মাসিকের অনিয়ম, ব্যথা বা অতিরিক্ত রক্তপাত দেখা দেয়।

ফাইব্রয়েড মানেই ভয় নয়, বরং এটি শরীরের দেওয়া এক সতর্ক সংকেত।
সময়মতো সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও চিকিৎসা নিলে এটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। মনে রাখবেন, নারীর শরীরের প্রতিটি পরিবর্তন একেকটি ভাষা, সেই ভাষা বোঝাই সুস্থতার প্রথম ধাপ। নিজেকে সময় দিন, পরীক্ষা করান, আর শরীরের সঙ্গে সম্পর্কটা আরও গভীরভাবে বুঝে নিন। কারণ, আপনার শরীরই আপনার শক্তি।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ