নিজের শরীরকেই অপছন্দ! আয়নায় দেখলেই অস্বস্তি! জানুন 'বডি ইমেজ ইস্যু'-এর পেছনের সত্য

নিজের শরীরকেই অপছন্দ! আয়নায় দেখলেই অস্বস্তি! জানুন 'বডি ইমেজ ইস্যু'-এর পেছনের সত্য
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আমরা প্রতিদিন আয়নায় নিজেদের দেখি। কিন্তু কতজন নিজের প্রতিবিম্বে সন্তুষ্ট? কেউ ভাবে, মুখটা অত মোটা কেন, কারও মনে হয় ত্বক যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়, কারও মনে হয় শরীরটা "পারফেক্ট" নয়। এই অস্বস্তি, আত্ম-অবিশ্বাস এবং নিজের শরীর নিয়ে নেতিবাচক ধারণার নামই "বডি ইমেজ ইস্যু" বা Body Image Issues। এটি শুধু বাহ্যিক রূপ বা সৌন্দর্য নিয়ে অসন্তোষ নয় বরং এটি এক গভীর মানসিক অবস্থা, যা আত্মসম্মান, মানসিক স্বাস্থ্য এবং জীবনের প্রতিটি সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।

"বডি ইমেজ" বলতে বোঝায় আমরা নিজের শরীরকে কীভাবে দেখি, অনুভব করি এবং মূল্যায়ন করি। এটি মূলত চারটি দিক নিয়ে গঠিত:

☞  Perceptual (অনুভূতিগত) - আমরা শরীরকে কেমন দেখি।

☞ Affective (আবেগিক) - শরীর নিয়ে আমাদের অনুভূতি কী।

☞ Cognitive (চিন্তাগত) - আমরা কীভাবে নিজের শরীর সম্পর্কে ভাবি।

☞  Behavioral (আচরণগত) - এই ভাবনা ও অনুভূতি আমাদের আচরণকে কীভাবে প্রভাবিত করে।

যখন এই উপলব্ধিগুলো বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তখনই 'বডি ইমেজ ইস্যু' শুরু হয়। 
 

কেন জন্ম নেয় শরীর সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা?

মানুষের শরীরবিষয়ক ধারণা কোনো শূন্যতায় তৈরি হয় না। সমাজ, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, এমনকি পরিবার, সবকিছুর মিলিত প্রভাবে এটি গড়ে ওঠে।

 

⇨ মিডিয়া ও সামাজিক প্রভাব:

বিজ্ঞাপন, সিনেমা, ফ্যাশন ও সোশ্যাল মিডিয়া- সব জায়গায় "আদর্শ শরীর" বলতে বোঝানো হয় এক সংকীর্ণ সৌন্দর্যের ছাঁচ। ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের "ফিল্টারড রিয়্যালিটি" মানুষকে ভুল ধারণা দেয় যে, সুন্দর মানে নিখুঁত চেহারা, নিখুঁত গঠন।এর ফলে স্বাভাবিক দেহের বৈচিত্র্যকে মানুষ ত্রুটি হিসেবে দেখতে শুরু করে।

 

⇨ জৈবিক ও মানসিক কারণ:

বয়স, হরমোন পরিবর্তন, ওজন ওঠানামা-এগুলো শরীরের আকৃতি ও আত্ম-চিত্রে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে কৈশোরে বা গর্ভধারণের পর নারীদের শরীর বদলে যায়, আর তখন সমাজের বিচারভঙ্গি এই পরিবর্তনকে "অসম্পূর্ণতা" হিসেবে চিহ্নিত করে।

 

⇨ সামাজিক তুলনা ও পারিবারিক মনোভাব: 

"ওর মতো ফিগার হলে ভালো হতো", "তুমি কেন এমন?"—এই তুলনাগুলো শিশু বয়স থেকেই মনের মধ্যে বসে যায়। যখন পরিবার বা বন্ধুমহল শরীর নিয়ে কটাক্ষ করে, তা আত্মবিশ্বাসে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে।

 

⇨  মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব:

Anxiety, depression, perfectionism ইত্যাদি মানসিক প্রবণতা বডি ইমেজ ইস্যুকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এটি রূপ নেয় Body Dysmorphic Disorder (BDD)-এ, যেখানে মানুষ নিজের শরীরের ক্ষুদ্র ত্রুটিকেও অতিরঞ্জিতভাবে দেখে।
 

মস্তিষ্কে যা ঘটে-

নিউরোসায়েন্স অনুযায়ী, যখন কেউ নিজের শরীর নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকে, তখন মস্তিষ্কের insula, amygdala, ও prefrontal cortex-এর মধ্যে যোগাযোগের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এতে "self-image" এবং "emotional response"-এর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। অর্থাৎ, শরীরের বাস্তব অবস্থা ও তার প্রতি আবেগের প্রতিক্রিয়া একে অপরের সঙ্গে মেলে না। এ কারণেই কেউ আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলেও "ভুলভাবে" তা উপলব্ধি করে।
 

পরিণতি: 

বডি ইমেজ ইস্যু কেবল আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে না; এটি মানসিক বিকার, খাদ্যজনিত ব্যাধি এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়।

নিজের চেহারা নিয়ে লজ্জা বা ঘৃণা স্থায়ী দুশ্চিন্তায় রূপ নেয়। এতে মানুষ নিজেকে জনসম্মুখে আনতে চায় না, বন্ধ হয় সামাজিক যোগাযোগ। অনেকেই আবার নিজের শরীর "সংশোধনের" নামে অতি উপবাস (Anorexia Nervosa) বা অতিরিক্ত খাওয়া (Bulimia) শুরু করে। বডি ইমেজ ইস্যু শুধু মনের রোগ নয় এটি আত্মপরিচয়ের সংকট।
 

বডি পজিটিভিটি: 

নিজের শরীরকে ভালোবাসা মানে আলস্য নয় বরং সেটি আত্মসম্মানের এক শক্তিশালী প্রকাশ। Body Positivity আন্দোলন মানুষের মনে সেই বার্তাই পৌঁছে দেয়— সৌন্দর্যের সংজ্ঞা এক নয়; তা বদলায় সময়, সংস্কৃতি ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী।

 

যেভাবে পরিবর্তন আনা যায়-

☞  সচেতন হোন মিডিয়া প্রভাব সম্পর্কে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখছেন, তার বেশিরভাগই সম্পাদিত, সাজানো, ফিল্টার করা ছবি। নিজের বাস্তবতা তার চেয়ে অনেক বেশি সত্যি ও মূল্যবান।

☞ নিজেকে তুলনা নয়, মূল্য দিন। তুলনা আত্মসম্মান কমায়; আত্মগ্রহণ সেটিকে গড়ে তোলে।

☞ মনোচিকিৎসা বা কাউন্সেলিং নিন। Cognitive Behavioral Therapy (CBT) বা body image–focused therapy অনেক ক্ষেত্রেই মানুষকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সাহায্য করে।

☞ বৈচিত্র্যকে উদযাপন করুন। মানুষ একে অপরের মতো নয়- এই ভিন্নতাই মানবিক সৌন্দর্যের মূলে।
 

'বডি ইমেজ ইস্যু' আধুনিক সমাজের এক নীরব মানসিক মহামারি। চেহারার মাপে আত্মমর্যাদা মাপতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই- মানুষের সৌন্দর্য তার অনুভূতি, স্নেহ, আর বুদ্ধিমত্তায়। সত্যিকারের সৌন্দর্য তখনই আসে, যখন আমরা আয়নায় নিজেদের ত্রুটি নয় আমাদের বাস্তবতাকে দেখি, গ্রহণ করি, ভালোবাসি। যে মুহূর্তে কেউ বলে, "আমি যথেষ্ট," সেই মুহূর্তেই শুরু হয় সুস্থ আত্ম-চিত্রের পুনর্জন্ম।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ