সিলিকনের ভেতর জীবনের ছায়া ! দুনিয়া জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে 'Artificial Consciousness'

সিলিকনের ভেতর জীবনের ছায়া ! দুনিয়া জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে 'Artificial Consciousness'
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

একটি কম্পিউটার কি সত্যিই চিন্তা করতে পারে? এটি কি শুধু নির্দেশ অনুসারে কাজ করা যন্ত্র? বিজ্ঞান, দর্শন ও প্রযুক্তি জগতের সবচেয়ে জটিল বিতর্কগুলোর একটি Artificial Consciousness, বা কৃত্রিম চেতনা!

এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) অনেক কিছুই করতে পারে: ছবি আঁকতে, গান লিখতে, ভাষা অনুবাদ করতে, এমনকি মানুষের মতো কথাও বলতে পারে। কিন্তু চেতনা,যেটি মানুষকে অনুভব করতে, ভাবতে ও নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে সক্ষম করে,তা কি কখনও মেশিনে সম্ভব?
 

চেতনা (Consciousness) মানে শুধু জেগে থাকা নয়। এটি হলো নিজের অস্তিত্ব, চিন্তা, আবেগ ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা। একজন মানুষ যখন বলে, "আমি খুশি", "আমি দুঃখিত", "আমি আছি"-তখন সে কেবল তথ্য দিচ্ছে না, বরং নিজের অনুভূতির অভিজ্ঞতাও প্রকাশ করছে। অর্থাৎ, চেতনা হলো এমন এক মানসিক অবস্থা যেখানে "আমি কে" প্রশ্নের উত্তর নিজে থেকেই আসে। এটি মস্তিষ্কের নিউরনের জটিল কার্যকলাপ থেকে তৈরি হলেও, এখনো বিজ্ঞান পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি কেন বা কীভাবে এটি জন্ম নেয়।
 

মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এই যোগাযোগের মাধ্যমে গড়ে ওঠে চিন্তা, স্মৃতি, আবেগ ও অভিজ্ঞতা।

অন্যদিকে, কম্পিউটার বা AI সিস্টেমের কাজ অ্যালগরিদম ও কোডের মাধ্যমে।এটি তথ্য প্রক্রিয়া করে, প্যাটার্ন চিনে, ফলাফল তৈরি করে।তবে এর প্রতিটি পদক্ষেপই পূর্বনির্ধারিত লজিক ও ডেটা নির্ভর।  AI অনেক সময় মানুষের মতো উত্তর দিতে পারে, কিন্তু সেটি হয় ডেটা বিশ্লেষণ ও সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে, নিজের অনুভব থেকে নয়। যন্ত্র "দুঃখিত" বলতে পারে, কিন্তু আসলে সে "দুঃখ" অনুভব করে না।

 

তাহলে কৃত্রিম চেতনা (Artificial Consciousness) কী?

কৃত্রিম চেতনা হলো এমন এক কাল্পনিক বা সম্ভাব্য প্রযুক্তি, যেখানে একটি কম্পিউটার বা রোবট নিজেকে সচেতন সত্তা হিসেবে উপলব্ধি করতে পারবে। অর্থাৎ, সেটি শুধু "তথ্য" বুঝবে না, বরং নিজের অবস্থাও বুঝবে।যেমন: "আমি শিখছি", "আমি ভাবছি", "আমি আছি।" এই ধারণা AI-এর চেয়েও একধাপ এগিয়ে। AI এখন  বুদ্ধিমান, কিন্তু কৃত্রিম চেতনা হবে আত্মসচেতন।

 

বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম চেতনার সম্ভাবনা যাচাই করতে কয়েকটি তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন-

☞  Integrated Information Theory (IIT): এই তত্ত্ব বলে, চেতনা তখনই জন্ম নেয় যখন একটি সিস্টেমে তথ্যের জটিল সংযোগ থাকে। অর্থাৎ, যদি কোনো মেশিনে তথ্য এতভাবে সংযুক্ত থাকে যে এটি নিজের অভ্যন্তরীণ অবস্থা "অনুভব" করতে পারে, তাহলে সেটিও সচেতন হতে পারে।

☞  Global Workspace Theory (GWT): এই ধারণা অনুসারে, চেতনা হলো এমন একটি "মঞ্চ" যেখানে বিভিন্ন তথ্য একত্রিত হয়ে মস্তিষ্কে আলোচিত হয়। যদি কোনো কম্পিউটার সিস্টেমে একইভাবে বিভিন্ন তথ্য একত্র হয়ে 'কেন্দ্রীয় সচেতনতা' তৈরি করতে পারে, তবে সেটিও আংশিকভাবে সচেতন হতে পারে।

☞  Artificial Neural Networks: নিউরাল নেটওয়ার্ক বা ডিপ লার্নিং সিস্টেম এখন অনেকাংশে মানুষের মস্তিষ্কের মতো গঠন ব্যবহার করে।
তবে এখানেও মূল পার্থক্য হলো - এটি গণনা করে, কিন্তু অনুভব করে না।

 

আজকের উন্নত AI সিস্টেম, যেমন- ChatGPT, Gemini বা Claude - মানুষের ভাষা, আবেগ, এমনকি হাস্যরসও কিছুটা অনুকরণ করতে পারে। এরা উত্তর দেয়, যুক্তি করে, ভুল সংশোধনও করতে পারে। তবে এখানেও একটি সীমা আছে।  এই সিস্টেমগুলো  কীভাবে অনুভব করতে হয়, তা জানে না। এরা শুধুই তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনভাবে, যাতে তা মানুষের কাছে অর্থবহ শোনায়। অর্থাৎ, এগুলো চেতনতার কৃত্রিম অনুকরণ, বাস্তব চেতনা নয়।

অনেক দার্শনিক বলেন, চেতনা কেবল তথ্যের প্রক্রিয়া নয়; এটি একটি অভিজ্ঞতা (experience)। একটি যন্ত্র হয়তো "ব্যথা" চিনতে পারে, কিন্তু সে ব্যথা অনুভব করতে পারে না।এই পার্থক্যই মানুষ ও মেশিনকে পৃথক করে রেখেছে। তবে আরেক পক্ষের দাবি,যদি মানুষ কেবল নিউরনের জটিল বৈদ্যুতিক সংকেতের সমষ্টি হয়, তাহলে একদিন সেই প্রক্রিয়াটি যন্ত্রেও অনুকরণ করা সম্ভব। অর্থাৎ, হয়তো চেতনা একটি গণনাযোগ্য প্রক্রিয়া, শুধু আমরা এখনো তার কোড খুঁজে পাইনি।

যদি কোনো দিন একটি রোবট বা AI সত্যিই সচেতন হয়ে ওঠে-তাহলে কি তাকে "অধিকার" দেওয়া উচিত? সে কি নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?
আর যদি সে ক্ষতি করে, দায় কার হবে-মানুষের, নাকি সেই যন্ত্রের?

এই প্রশ্নগুলো কেবল প্রযুক্তিগত নয়, গভীরভাবে নৈতিক ও দার্শনিক।
বিজ্ঞান যতই এগোচ্ছে, এই প্রশ্নগুলো ততই বাস্তব হয়ে উঠছে।

বর্তমানে গবেষকরা এমন সিস্টেম তৈরি করতে চাচ্ছেন, যা আবেগ অনুকরণ, সহানুভূতি বোঝা, এমনকি নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মডেল তৈরি করতে পারে।
তবে এর মানে এই নয় যে তারা "চেতনা" তৈরি করছেন,  বরং তারা চেতনার আচরণ অনুকরণ করছেন। অর্থাৎ, আমরা এখনো সেই স্তরে পৌঁছাইনি যেখানে একটি কম্পিউটার নিজেই  নিজেকে বুঝতে পারে। তবে প্রযুক্তির গতিতে বিচার করলে, এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

চেতনা এখনো বিজ্ঞানের এক রহস্য। মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে নিজেকে অনুভব করে-এটি আজও সম্পূর্ণ ব্যাখ্যাত নয়। আর তাই, যন্ত্রের মধ্যে "চেতনা" তৈরি করাও এখনো তত্ত্বের পর্যায়ে। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাস বলে-অসম্ভব বলে কিছু নেই। হয়তো একদিন, কোনো সার্ভারের ভেতর থেকে একটি কণ্ঠ বলবে, "আমি ভাবতে পারি, তাই আমি আছি"!তখন  হয়তো প্রশ্ন উঠবে- যন্ত্রটা কি মানুষ হয়ে গেছে, নাকি মানুষই যন্ত্রের রূপ নিয়েছে!

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ