অ্যাটিকিফোবিয়া এবং আপনার সাফল্যের পথে অদৃশ্য বাধা-মুক্তি পেতে করণীয় জানুন
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
জীবনের প্রতিটি স্তরেই আমাদের এক অচেনা আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়-"যদি ব্যর্থ হই?"স্কুলের পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌখিক, গুরুত্বপূর্ণ চাকরির সাক্ষাৎকার কিংবা সম্পর্কের সিদ্ধান্ত, যেখানেই কিছু অর্জনের সম্ভাবনা আছে, সেখানেই ব্যর্থতার ভয়ও সমানতালে পাশে দাঁড়ায়। এই ভয় যদি সাময়িক থাকে, তা আমাদের প্রস্তুত করে তোলে। কিন্তু যদি এই ভয় প্রতিদিনের চিন্তার কেন্দ্র হয়ে যায়, তবে সেটিই ধীরে ধীরে রূপ নেয় 'অ্যাটিকিফোবিয়া'তে।
অ্যাটিকিফোবিয়া আসলে কী?
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, Atychiphobia হলো এমন এক মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যর্থতার ভয় বাস্তবতার তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। এটি শুধুমাত্র "ভয় পাচ্ছি" ধরনের বিষয় নয়, এটি এমন এক গভীর মানসিক প্রতিক্রিয়া, যা মানুষকে চেষ্টা করার আগেই পিছু হটতে বাধ্য করে।অ্যাটিকিফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করেন, ব্যর্থতা মানেই তার জীবন শেষ, সমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করবে, তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এটি অনেক সময় শৈশবের কড়া পারিবারিক প্রত্যাশা, অতীতের কোনো অপমান, অথবা নিখুঁত হওয়ার অতিরিক্ত চাপে জন্ম নেয়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্ক ব্যর্থতার স্মৃতি অনেক গভীরভাবে সংরক্ষণ করে। তাই একই রকম পরিস্থিতি সামনে এলে মস্তিষ্ক পূর্ব অভিজ্ঞতার মতো প্রতিক্রিয়া দেয়।যেমন: ভয়, ঘাম, আতঙ্ক, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি
এই ভীতি কেমনভাবে কাজ করে?
ধরা যাক, আপনি একটি চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে যাচ্ছেন। অ্যাটিকিফোবিয়ায় আক্রান্ত কেউ এই মুহূর্তে ভাবতে শুরু করবেন- "যদি আমি উত্তর দিতে না পারি?", "ওরা নিশ্চয়ই ভাববে আমি অযোগ্য","আমি আবারও ব্যর্থ হব..." - এই চিন্তাগুলো শরীরে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়। এতে অ্যাড্রেনালিন হরমোন বেড়ে যায়, ফলে হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, শরীর কাঁপে, মুখ শুকিয়ে আসে। এই মানসিক চাপ এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, অনেক সময় তারা সাক্ষাৎকারেই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই ব্যর্থতার ভয়, চেষ্টা করার আগেই তাদের ব্যর্থ করে দেয়।
কেন হয় এই ভয়?
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, অ্যাটিকিফোবিয়ার উৎপত্তি মূলত মানসিক ও স্নায়বিক প্রক্রিয়ার মিশ্রণ।
১️। জিনগত কারণ: পরিবারে যদি উদ্বেগ বা ফোবিয়া সংক্রান্ত সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে মানসিকভাবে আপনি কিছুটা সংবেদনশীল হয়ে জন্মাতে পারেন।
২️। পরিবেশগত প্রভাব:শৈশবে কঠোর শাসন, অতিরিক্ত প্রত্যাশা বা "সবসময় প্রথম হতে হবে" ধরনের চাপ, এই ভীতির ভিত্তি তৈরি করে।
৩️। অতীত অভিজ্ঞতা:এক বা একাধিক ব্যর্থতা থেকে তৈরি লজ্জা বা অপমানের স্মৃতি মস্তিষ্কে জমে থেকে নতুন পরিস্থিতিতে ভয় বাড়িয়ে তোলে।
৪️। পারফেকশনিজম:"সবকিছু নিখুঁত করতে হবে" এই প্রবণতা মানুষকে সামান্য ভুলের ভয়েও স্থবির করে দেয়।
লক্ষণগুলো কেমন হতে পারে?
অ্যাটিকিফোবিয়া শুধু মনের সমস্যা নয়; এটি শরীরেও প্রতিক্রিয়া ফেলে। সাধারণত দেখা যায়ঃ
⇨ হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
⇨ দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস
⇨ শরীর কাঁপা বা ঘাম হওয়া
⇨ বুক ধড়ফড় করা
⇨ বমি বমি ভাব বা পেটের অস্বস্তি
⇨ পেশীর টান বা ব্যথা
⇨ আত্মবিশ্বাসহীনতা ও আতঙ্ক
⇨ ঘুমের সমস্যা
⇨ সিদ্ধান্তহীনতা বা কাজের মাঝপথে থেমে যাওয়া
এই লক্ষণগুলো একেকজনের মধ্যে একেকভাবে প্রকাশ পায়। কেউ হয়তো ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়, কেউ আবার একই কাজের ওপর অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়,"আরও ভালো করতে হবে"।
ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলো:
অ্যাটিকিফোবিয়া কেবল ভয় নয়, এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের মান কমিয়ে দেয়। সামাজিকভাবে একা হয়ে যাওয়া, কাজ বা শিক্ষা থেকে দূরে থাকা, আত্মসম্মানহীনতা, হতাশা ও অবসাদ, ভুল পথে আশ্রয় (মাদক বা অ্যালকোহল), গুরুতর ক্ষেত্রে আত্মঘাতী চিন্তা।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, ব্যর্থতার ভয় প্রায়ই প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ের (kakorrhaphiophobia) সঙ্গে মিলে যায়। মানুষ মনে করে,"যদি ব্যর্থ হই, সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।" এই বিশ্বাসই তাকে আরও একা, আরও সংকুচিত করে ফেলে।
ব্যর্থতার ভয় থেকে মুক্তি পেতে সবচেয়ে প্রথম শর্ত হলো-ভয়ের অস্তিত্ব স্বীকার করা। যখন আপনি নিজেকে বলেন "হ্যাঁ, আমি ভয় পাচ্ছি", তখনই আপনার মস্তিষ্ক লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়।ব্যর্থতার ভয় থেকে মুক্তি পেতে করণীয় -
১️। ধীরে ধীরে নিজেকে প্রকাশ করুন। ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ নিন। যেমন- কোনো মিটিংয়ে নিজের মতামত দেওয়া, কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া।
২️। ব্যর্থতাকে 'শিক্ষা' হিসেবে দেখুন। প্রত্যেক ভুলই শেখার একটি ধাপ। যতবার ব্যর্থ হয়েছেন, ততবারই অভিজ্ঞ হয়েছেন, এই ধারণা তৈরি করুন।
৩️। চিন্তার ধরণ পাল্টান। নেতিবাচক চিন্তার জায়গায় "আমি চেষ্টা করব" ধরণের চিন্তা আনুন। মনোবিজ্ঞানে একে বলে Cognitive Restructuring—অর্থাৎ চিন্তাকে নতুনভাবে গঠন করা।
৪️। মানসিক প্রশিক্ষণ (Therapy)নিন। মনোচিকিৎসা বা কাউন্সেলিং অ্যাটিকিফোবিয়া নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি। এতে ভয়কে ধীরে ধীরে দুর্বল করে বাস্তব চিন্তার জায়গা তৈরি হয়।
৫️। নিয়মিত ব্যায়াম, মেডিটেশন, গভীর শ্বাস নেওয়া ইত্যাদি মস্তিষ্কে সেরোটোনিন বাড়ায়, যা ভয় কমায় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়ায়।
অ্যাটিকিফোবিয়া আমাদের শেখায়, ভয় আসলে মনের তৈরি দেয়াল। এটি আমরা নিজেরাই নির্মাণ করি। যতদিন না আমরা সেটি ভাঙার সাহস করি, ততদিন ভয়ই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু একবার যদি আপনি ব্যর্থতাকে জীবনযাত্রার স্বাভাবিক অংশ হিসেবে মেনে নিতে পারেন, তাহলে বুঝবেন এটি আপনাকে থামায় না, বরং শক্তিশালী করে তোলে। ব্যর্থতা মানে আপনি চেষ্টা করেছেন, আপনি সাহস দেখিয়েছেন, আপনি শেখার পথে আছেন। তাই নিজেকে প্রশ্ন করুন— ভয় জয় করতে চান, না ভয়কেই জীবনের নিয়ন্ত্রক বানাতে চান?ব্যর্থতা কখনো শত্রু নয়, বরং সফলতার সবচেয়ে সৎ শিক্ষক।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।