মন, অনুভূতি আর শিক্ষা-Emotional Learning বদলে দিচ্ছে শেখার ধরন !

মন, অনুভূতি আর শিক্ষা-Emotional Learning বদলে দিচ্ছে শেখার ধরন !
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

পড়াশোনা মানেই কি কেবল তথ্য মুখস্থ করা, সূত্র মনে রাখা আর পরীক্ষা পাস করা! মানুষের শেখার প্রক্রিয়া আসলে আরও গভীর। এটি কেবল মস্তিষ্কের নয়, মন ও আবেগেরও ব্যাপার। শিক্ষা কখনও শুষ্ক নয়, এটি তখনই অর্থবহ হয় যখন তা আবেগকে স্পর্শ করে। এ কারণেই আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও নিউরোসায়েন্সে "Emotional Learning" এখন শিক্ষা গবেষণার অন্যতম আলোচিত বিষয়।

'Emotional Learning' কী?

'Emotional Learning' বলতে বোঝায় এমন এক শেখার প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষার্থী নিজের আবেগ, অনুভূতি ও মানসিক প্রতিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে তথ্য গ্রহণ ও বোঝার ক্ষমতা বাড়ায়।
অর্থাৎ, কোনো জ্ঞান তখনই দীর্ঘস্থায়ী হয় যখন সেটি শিক্ষার্থীর মনে আবেগিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে- আনন্দ, আগ্রহ, সহানুভূতি বা কৌতূহল।

 

মস্তিষ্কে শেখা ও আবেগের সংযোগ

শেখা ও আবেগ একে অপরের পরিপূরক।
মস্তিষ্কের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ -

১। Amygdala: আবেগ প্রক্রিয়াকরণে ভূমিকা রাখে।

২। Hippocampus: স্মৃতি গঠনের কেন্দ্র।

 

এই দুটি অংশ সরাসরি সংযুক্ত।
যখন আমরা কোনো বিষয় নিয়ে উত্তেজিত, আনন্দিত বা অনুপ্রাণিত হই, তখন Amygdala সক্রিয় হয়ে ওঠে, এবং Hippocampus সেই অভিজ্ঞতাকে গভীরভাবে সংরক্ষণ করে।
ফলস্বরূপ, আবেগময় অভিজ্ঞতা দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ —
যখন কোনো শিক্ষক গল্পের মাধ্যমে পড়ান বা বাস্তব জীবনের উদাহরণ দেন, তখন শিক্ষার্থীরা শুধু বিষয়টি শেখে না, তা অনুভবও করে। এ কারণেই শিশুকালে শেখা গান, কবিতা বা গল্প আমাদের মনে থেকে যায় আজীবন।
 

আবেগ কেন শেখাকে প্রভাবিত করে?

শিক্ষা শুধু বুদ্ধির নয়; এটি মনোযোগ, আগ্রহ, আত্মবিশ্বাস ও সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল।
এগুলো প্রত্যেকটিই আবেগের সঙ্গে সম্পর্কিত।

যখন কোনো বিষয় আমাদের আনন্দ বা আগ্রহ জাগায়, মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ হয়। এই হরমোন মনোযোগ ধরে রাখে, শেখার আনন্দ বাড়ায়।
তাই আনন্দময় শিক্ষার পরিবেশে শেখার গতি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। আবার, শুধু তথ্য মুখস্থ করলে তা অল্পদিনেই ভুলে যাই।
কিন্তু কোনো ঘটনার সঙ্গে যদি অনুভূতি জুড়ে থাকে, তা মস্তিষ্ক দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করে। অতএব, আবেগ হলো স্মৃতির 'গ্লু'।

শিক্ষার্থী যখন নিজের প্রচেষ্টাকে মূল্যবান মনে করে, তখন শেখার ইচ্ছা বাড়ে। অন্যদিকে ভয়, চাপ বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া মস্তিষ্কের শিখন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।

শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানবিক বিকাশ। যখন শিক্ষা ভালোবাসা, সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার পরিবেশে হয়, তখন শিক্ষার্থীরা emotional intelligence বা আবেগিক বুদ্ধিমত্তা অর্জন করে, যা জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।
 

নিউরোসায়েন্সে একে বলা হয় "Emotion-Cognition Integration"।
গবেষণায় দেখা গেছে, যখন শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা ইতিবাচক থাকে (যেমন আত্মবিশ্বাস, আগ্রহ, আনন্দ), তখন মস্তিষ্কের prefrontal cortex সক্রিয় হয়, যা শেখা ও সমস্যা সমাধানে সহায়ক।কিন্তু যখন শিক্ষার্থী ভয়, চাপ বা অপমান অনুভব করে, তখন amygdala-র 'threat response' সক্রিয় হয়, যা চিন্তা, যুক্তি ও স্মৃতিশক্তি দুর্বল করে দেয়। অর্থাৎ, ভয় বা চাপের মধ্যে শেখা হয়ত সম্ভব, কিন্তু তা কখনও গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
 

আজকের শিক্ষা মনোবিজ্ঞান বলছে একজন শিক্ষক যত বেশি শিক্ষার্থীর অনুভূতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন, শেখা তত বেশি কার্যকর হয়-

☞ গল্পভিত্তিক শেখানো: গল্প, বাস্তব উদাহরণ ও ভিজ্যুয়াল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর আগ্রহ বাড়ানো যায়।

☞ সহানুভূতিশীল যোগাযোগ: শিক্ষার্থীকে ভুল করার স্বাধীনতা দেওয়া, সমালোচনার বদলে উৎসাহ দেওয়া।

☞ সহযোগিতামূলক পরিবেশ: দলীয় কাজ বা peer-learning আবেগিক সংযোগ ও পারস্পরিক সম্মান বাড়ায়।

☞ সৃজনশীল শিক্ষণ পদ্ধতি: গান, নাটক, চিত্রকলা, বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক শেখা আবেগের অংশগ্রহণ বাড়ায়।
 

শুধু আবেগ থাকা নয়, সেটি নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতাও শেখার অংশ। শিক্ষার্থীদের শেখানো দরকার—কীভাবে ব্যর্থতা, ভয় বা উদ্বেগকে ইতিবাচক শক্তিতে রূপান্তর করা যায়।একেই বলা হয় "Emotional Regulation", যা আত্মসংযম ও মানসিক পরিপক্কতার চাবিকাঠি।

শেখা কেবল জ্ঞান নয়, এটি এক মানসিক যাত্রা।যেখানে পাঠ্যবই, শিক্ষক, অভিজ্ঞতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  "আবেগ" একসঙ্গে কাজ করে।আবেগ ছাড়া শিক্ষা হয়তো তথ্য দেয়, কিন্তু অনুপ্রেরণা দেয় না। অন্যদিকে, যখন শিক্ষার সঙ্গে আবেগ জুড়ে যায়, তখন শেখা হয়ে ওঠে অর্থপূর্ণ, স্মরণীয়, এবং সবচেয়ে বড় কথা-মানবিক। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শুধু "কীভাবে শেখানো যায়" নয়, বরং "কীভাবে অনুভব করানো যায়।" কারণ মন ছুঁয়ে শেখাই আসল শেখা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ