এক বাড়ি, দুই দেশ-বিশ্বের একমাত্র দ্বীপ যেখানে সীমানা কেটে গেছে ঘরের মাঝখান দিয়ে!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ভাবুন তো, আপনি সকালে নাশতা করলেন এক দেশে বসে, আর দুপুরের খাবার খেলেন অন্য দেশে! শুনতে যেন সিনেমার গল্প, কিন্তু বাস্তবেই এমন একটি জায়গা আছে পৃথিবীতে, যেখানে একটি বাড়ির মধ্য দিয়েই চলে গেছে দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা।এই বিস্ময়কর জায়গাটির নাম বের্লে–হার্তগ (Baarle-Hertog) ও বের্লে–নাসাউ (Baarle-Nassau),একই গ্রামে পাশাপাশি থাকা বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের শহর, যাদের সীমারেখা এমনভাবে আঁকা যে, অনেক বাড়িই একসঙ্গে দুই দেশের অন্তর্ভুক্ত!
কোথায় এই অদ্ভুত সীমান্ত?
এই ব্যতিক্রমী গ্রামটি অবস্থিত পশ্চিম ইউরোপে, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের সীমানায়।
প্রায় ৩০টির মতো ছোট ছোট ভূখণ্ড (enclave) নিয়ে গঠিত এই এলাকা-
◑ কিছু অংশ বেলজিয়ামের,
◑ কিছু অংশ নেদারল্যান্ডসের,
আবার কিছু জায়গা এমন আছে যেখানে এক দেশের ভেতরে অন্য দেশের ক্ষুদ্র ভূখণ্ড গেঁথে গেছে।এত জটিল সীমানা পৃথিবীর আর কোথাও নেই!
এই অদ্ভুত বিভাজনের সূত্র পাওয়া যায় মধ্যযুগে (বারো শতকে)। তখন স্থানীয় ডাচ ও বেলজিয়ান জমিদাররা নিজেদের জমি বিনিময় ও ভাড়ায় দিতেন, কিন্তু সীমানার স্পষ্ট নথি তৈরি হয়নি। ফলে শতাব্দী ধরে জমির মালিকানা নিয়ে তৈরি হয় এক অদ্ভুত মিশ্র মানচিত্র, যেখানে এক দেশের ভেতর অপর দেশের ছোট ছোট টুকরো ভূমি ছড়িয়ে পড়ে।যখন ১৮৩১ সালে বেলজিয়াম স্বাধীনতা লাভ করে, তখন এই বিশৃঙ্খল সীমারেখা বজায় থাকে। বহু বছর ধরে আলোচনা চললেও, কেউই তা পুরোপুরি বদলাতে পারেনি।আজও সেই ঐতিহাসিক জটিলতার ফলেই এক বাড়ি, দুই দেশ -এমন অদ্ভুত বাস্তব চিত্র দেখা যায়।
বের্লে গ্রামের সবচেয়ে আলোচিত বাড়িগুলোর একটি হলো এমন একটি ঘর, যার ড্রয়িংরুম নেদারল্যান্ডসে, আর রান্নাঘর ও শোবার ঘর বেলজিয়ামে! বাড়ির ভেতরেই মেঝেতে আঁকা আছে একটি সাদা ড্যাশ লাইন, সেই লাইনই আন্তর্জাতিক সীমান্ত!বাড়ির এক অংশে ট্যাক্স, আইন ও প্রশাসন চলে নেদারল্যান্ডসের নিয়মে, আর অন্য অংশে বেলজিয়ামের।দোকান, ক্যাফে ও বাড়ির মালিকরা নিজেদের ব্যবসা বা বাসস্থানের জন্য অনেক সময় পছন্দসই দেশ বেছে নেন, যেখানে ট্যাক্স কম বা নিয়ম সুবিধাজনক।
প্রশাসনিক বাস্তবতা-
এমন জটিল ব্যবস্থায় জীবনযাপন সহজ নয়, তাই উভয় দেশ একসঙ্গে কাজ করে—একই রাস্তায় দুটি পৌরসভা (মেয়র) রয়েছে,কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য একই পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কাজ করে, ডাকবাক্স, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ - দুটো দেশের কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে পরিচালনা করে। এমনকি ঘড়ির সময় পর্যন্ত একসময় ভিন্ন ছিল। যদিও বর্তমানে উভয় দেশ ইউরোপিয়ান টাইমে সমন্বিত।
২০২০ সালে যখন ইউরোপে করোনা সংক্রমণ বাড়ল, তখন দুই দেশের নিয়মও ছিল আলাদা।বেলজিয়াম অংশে দোকান বন্ধ, কিন্তু একই দোকানের অন্য পাশে যেটি নেদারল্যান্ডসের ভূখণ্ডে, সেটি খোলা! অনেকে বলেছিলেন, "এক দোকানের অর্ধেক খোলা, অর্ধেক বন্ধ" এমন দৃশ্য পৃথিবীতে শুধু এখানেই দেখা গেছে।
এই সীমান্ত-অদ্ভুত শহর আজ ইউরোপের অন্যতম পর্যটন স্পট।রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া সীমানা রেখা দেখতে প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসে। রাস্তার মাটিতে ছোট ছোট সাদা '+' চিহ্ন দিয়ে লেখা থাকে- B (বেলজিয়াম) ও NL (নেদারল্যান্ডস)।এক পা ফেলে আপনি বেলজিয়ামে, আরেক পা ফেললেই নেদারল্যান্ডসে! এখানে "সীমানা হাঁটা ট্যুর (Border Walk Tour)" নামে বিশেষ হাঁটার আয়োজন করা হয়, যেখানে পর্যটকরা একই রাস্তা ধরে কয়েক মিনিটেই দুই দেশ ঘুরে ফেলতে পারেন ।
এই এলাকায় একটি বাড়ির কোন দেশভুক্ত তা নির্ভর করে মূল দরজা কোন পাশে অবস্থিত তার ওপর।যদি দরজা বেলজিয়াম অংশে হয়, তাহলে বাড়িটি বেলজিয়ান বলে গণ্য হয়। কখনও কখনও পরিবাররা দরজা সরিয়ে নিয়েছে, যাতে দেশ বদলে যায় ও কর কমে! এছাড়া স্কুল, পোস্ট অফিস বা স্বাস্থ্যসেবার জন্য বাসিন্দারা নিজেদের পছন্দের দেশের সুবিধা নিতে পারেন। এই দুই দেশের মানুষের সহাবস্থানই পৃথিবীতে এক অনন্য উদাহরণ- সীমানা নয়, সহাবস্থানই আসল শক্তি।
ভূগোলবিদরা বলেন, বের্লে গ্রামের সীমারেখা পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল এনক্লেভ সিস্টেম। এটি আন্তর্জাতিক সীমানা ধারণার এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ, যেখানে প্রশাসনিক বিভাজন মানুষের সহাবস্থানকে ব্যাহত না করে বরং বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে।রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় বের্লে–হার্তগ ও বের্লে–নাসাউ প্রায়ই উল্লেখ করা হয় "মানবিক সীমারেখা" (Humanized Border) হিসেবে।
বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের বের্লে গ্রামের এই অদ্ভুত সীমারেখা শুধু মানচিত্রের কৌতূহল নয়, এটি এক সহাবস্থানের প্রতীক।যেখানে এক বাড়ির মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া সীমানাও মানুষকে বিভক্ত করে না, বরং এক করে রাখে। এ যেন পৃথিবীর মুখে লেখা এক শান্তির বার্তা,"সীমানা মানচিত্রে থাকে, মনের ভেতর নয়।"
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।