দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই মাছের ঝোল খেলে জিভে লেগে থাকবে রহস্যের স্বাদ!

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই মাছের ঝোল খেলে জিভে লেগে থাকবে রহস্যের স্বাদ!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রন্ধনশৈলীতে এমন কিছু খাবার আছে যেগুলোর প্রতিটি কণা যেন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্বাদের গল্প বলে। আসাম পেদাস (Asam Pedas) তেমনই এক অনন্য পদ। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের রান্নাঘরে জনপ্রিয় এই টক-মসলাদার মাছের ঝোল একদিকে যতটা ঝাঁঝালো, ততটাই ভারসাম্যপূর্ণ ও গভীর স্বাদের।"আসাম" অর্থ টক, আর "পেদাস" মানে ঝাল দুইয়ের মেলবন্ধনে তৈরি হয় এই সুগন্ধি ও প্রাণবন্ত কারি, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রান্নার পরিচয়বাহী স্বাদবিস্ফোরণ।

উৎস ও ইতিহাস:

আসাম পেদাস-এর উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ থাকলেও ধারণা করা হয়, এটি মূলত মালয় উপদ্বীপে উদ্ভূত।প্রাচীন মালয় বাণিজ্যিক রুটে ভারতীয় ও চীনা ব্যবসায়ীদের প্রভাবে এখানে মশলা ও টক উপাদান (তেঁতুল, লেবু, আনারস) ব্যবহারের প্রচলন বাড়ে।এই সংস্কৃতির মিশ্রণেই জন্ম নেয় আসাম পেদাস, যেখানে ভারতীয় মসলার তীব্রতা, চীনা স্যুপের স্বচ্ছতা, আর মালয়েশিয়ান রন্ধনপ্রণালীর টক স্বাদ একসাথে মিশে যায়।

 

উপকরণ :

আসাম পেদাসের সৌন্দর্য তার ভারসাম্যে-ঝাল, টক ও মিষ্টতার সূক্ষ্ম সংমিশ্রণ।প্রধান উপকরণগুলো হলো:

☞ মাছ । সাধারণত ম্যাকারেল, রেড স্ন্যাপার বা আইক কেম্বুং ব্যবহৃত হয়।

☞ টক উপাদান। তেঁতুল বা আসাম কেপিং (তেঁতুলজাত ফল) এই পদটির মূল আত্মা।

☞ মসলা।যেমন : লাল মরিচ, হলুদ, আদা, পেঁয়াজ, রসুন ও লেমনগ্রাস।

☞ অন্যান্য স্বাদবর্ধক হিসেবে  টমেটো, বেগুন, আনারস বা ওকরা (ঢেঁড়স) রয়েছে, যা টেক্সচার ও স্বাদে বৈচিত্র্য আনে।

 

এই পদে তেঁতুলের অম্লতা মুখে প্রথমেই লাগে, তারপর ধীরে ধীরে মরিচের তীব্র ঝাঁজ জিহ্বায় ছড়িয়ে পড়ে, আর শেষে মাছে মিশে থাকা রস এক অনন্য গভীর স্বাদ দেয়, যেন ঝাল, টক ও তৃপ্তির এক নিখুঁত ত্রিবেণী।

আসাম পেদাস রান্নায় ব্যবহার হয় "slow simmering" পদ্ধতি। মাঝারি আঁচে দীর্ঘসময় ধরে ঝোল ফোটানো হয় যাতে তেঁতুল ও মসলার রাসায়নিক যৌগগুলো পরস্পরে মিশে যায়। তেঁতুলে থাকা tartaric acid ও citric acid প্রোটিনকে ভেঙে মাছকে করে কোমল, একইসাথে মসলার তেলজাত উপাদানগুলোকে সক্রিয় করে। ফলে স্বাদ গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। এভাবে রান্না করা আসাম পেদাসের ঝোল হালকা হলেও ঘ্রাণ ও স্বাদে থাকে শক্তিশালী প্রভাব।

আসাম পেদাস কেবল এক রেসিপি নয়, এটি এক আঞ্চলিক অভিব্যক্তি। মালয়েশিয়ার মেলাকা সংস্করণে ঝোল হয় ঘন, টমেটোর আধিক্য থাকে। জোহর অঞ্চলে মরিচের পরিমাণ বেশি, স্বাদও হয়  তুলনামূলক ঝাল। ইন্দোনেশিয়ার রিয়াউ বা সুমাত্রা দ্বীপে এতে যোগ হয় দই বা নারকেল দুধের হালকা ছোঁয়া, যা টকভাব কমিয়ে মোলায়েম স্বাদ আনে। সাধারণত এটি পরিবেশন করা হয় সাদা ভাত, উলং সবজি বা ভাজা মাছের সঙ্গে, যাতে মুখে টক-ঝাল স্বাদ ভারসাম্যপূর্ণ থাকে।

 

পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্যগত দিক:

আসাম পেদাস শুধু স্বাদের নয়, পুষ্টির দিক থেকেও সমৃদ্ধ।

☞ মাছের প্রোটিন ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

☞ তেঁতুলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হজমে সাহায্য করে ও শরীরের টক্সিন দূর করে।

☞ লেমনগ্রাস ও মরিচের ক্যাপসাইসিন মেটাবলিজম বাড়ায়, সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
 

অর্থাৎ, এটি এমন এক খাবার যা স্বাদের পাশাপাশি শরীরকেও দেয় উপকার।

 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘরোয়া রান্নায় আসাম পেদাসের উপস্থিতি মানে উষ্ণতা, অতিথিপরায়ণতা ও ঐতিহ্যের সুবাস।গ্রামীণ পরিবারগুলোতে বিশেষ অতিথি এলে প্রথমেই পরিবেশন করা হয় এই পদ, কারণ এটি মশলাদার স্বাগতের প্রতীক। রান্নার সময় এর ঝাঁজালো সুবাস গোটা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে, যেন পরিবার, ঐতিহ্য ও স্বাদের এক উৎসব।

আসাম পেদাস কোনো সাধারণ মাছের ঝোল নয়,এটি স্বাদের ইতিহাস, ভৌগোলিক সংমিশ্রণ ও রন্ধনশিল্পের এক নিখুঁত সিম্ফনি। আজ যখন বিশ্ব রান্নায় "ফিউশন" কথাটি জনপ্রিয়, আসাম পেদাস সেই ঐতিহ্যবাহী ফিউশন, যেখানে টক, ঝাল ও সুবাস একসাথে জীবন্ত হয়ে ওঠে।এক চামচ আসাম পেদাসে আছে স্বাদের ইতিহাস,যা মশলার মতোই তীব্র, তেঁতুলের মতোই টক, আর সংস্কৃতির মতোই গভীর।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ