জার্মানির 'Dual Education System': একসাথে পড়াশোনা আর চাকরির ট্রেনিং-সফলতার এই ফর্মুলা জানেন?

জার্মানির 'Dual Education System': একসাথে পড়াশোনা আর চাকরির ট্রেনিং-সফলতার এই ফর্মুলা জানেন?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আধুনিক বিশ্বে শুধু বইয়ের জ্ঞানই নয়, বাস্তব দক্ষতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।কিন্তু এই দুইকে একসাথে ধরে রাখা কতটা সম্ভব! জার্মানিরা তাদের বিখ্যাত "Dual Education System"-এর মাধ্যমে,সেই প্রশ্নের এক বাস্তব ও সফল উত্তর দিয়েছে।এটি এমন এক শিক্ষা মডেল যেখানে ছাত্ররা একই সঙ্গে তাত্ত্বিক জ্ঞান ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ লাভ করে, এবং পড়াশোনার সময়ই পেশাগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায়। ফলে শিক্ষা শেষের পর সরাসরি কর্মসংস্থান, যা জার্মানিকে আজ ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী শ্রমবাজারে পরিণত করেছে।

কী এই 'Dual Education System'?

Dual Education System মূলত এমন একটি শিক্ষা কাঠামো, যেখানে শিক্ষার্থীরা সময় ভাগ করে দুই জায়গায় শেখে।একদিকে ভোকেশনাল স্কুলে (Berufsschule) তাত্ত্বিক পাঠ,অন্যদিকে কোনো প্রতিষ্ঠানে বা কোম্পানিতে বাস্তব প্রশিক্ষণ (On-the-job training)। এই দুই দিকের সমন্বয়েই তৈরি হয় "Dual" বা দ্বৈত শিক্ষা।  এটি এক ধরনের "learn and earn" ব্যবস্থা, যেখানে শিক্ষার্থীরা শেখার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের সময় পারিশ্রমিকও পায়।

 

কীভাবে কাজ করে এই মডেল?

জার্মানির এই পদ্ধতিতে সাধারণত শিক্ষার্থীরা দুই থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে এই ডুয়াল প্রোগ্রামে অংশ নেয়। পুরো সময়ের প্রায় ৭০% সময় তারা কাটায় কোনো প্রতিষ্ঠানে, যেখানে বাস্তব কাজ শেখানো হয়, আর ৩০% সময় যায় তাত্ত্বিক পাঠে।উদাহরণস্বরূপ- একজন "মেকানিক্যাল টেকনিশিয়ান" হতে চাওয়া শিক্ষার্থী সপ্তাহে ৩ দিন কোনো অটোমোবাইল কোম্পানিতে কাজ করে, আর বাকি ২ দিন ভোকেশনাল স্কুলে গিয়ে,যন্ত্রবিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্ব, গণিত ও নিরাপত্তা নীতি শিখে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেয় জ্ঞান ও তত্ত্ব।আর প্রতিষ্ঠান দেয় বাস্তব অভিজ্ঞতা ও কাজের দক্ষতা। দুইয়ের সমন্বয়ে শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে এমন এক কর্মী, যার হাতে একসাথে থাকে জ্ঞান ও প্রয়োগ, যা আধুনিক শিল্পক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।

এই মডেলের শিকড় ১৯শ শতকের জার্মান গিল্ড সংস্কৃতিতে, যেখানে কারিগররা তাদের শিক্ষানবিশদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতেন।সময়ের সাথে, সরকার ও বাণিজ্য সংস্থাগুলো এই ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। ১৯৬৯ সালে জার্মান সরকার Vocational Training Act (BBiG) পাশ করে, যার মাধ্যমে ডুয়াল সিস্টেমকে জাতীয় কাঠামোয় আনা হয়।এখন এই ব্যবস্থায় প্রায় ৩৪০টির বেশি পেশাগত ট্রেনিং প্রোগ্রাম রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যাংকিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, হেলথ কেয়ার, আইটি, ও এমনকি মিডিয়া-সম্পর্কিত ক্ষেত্রও।

জার্মানিতে বেকারত্বের হার ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর একটি বড় কারণ এই Dual System।প্রায় ৬০% জার্মান তরুণ এই মডেলে শিক্ষা নেয়।প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় ৯০% শিক্ষার্থীই চাকরি পেয়ে যায়। ৮০% কোম্পানি বলছে, তারা নিজেদের কর্মী নিয়োগ দেয় তাদেরই ডুয়াল ট্রেনিং প্রোগ্রাম থেকে।এই পদ্ধতি শুধুমাত্র ব্যক্তিকে নয়, পুরো অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।কারণ, দক্ষ জনশক্তিই শিল্প বিকাশের মেরুদণ্ড।

শিক্ষাবিদদের মতে, Dual System হলো "Theory-Practice Integration Model", যা মস্তিষ্ক ও হাত, দুটিকেই একসাথে কাজে লাগায়।এটি কেবল জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া নয়, বরং বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতিও।অর্থনীতিবিদদের মতে, এই মডেল 'skills gap' কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যা শিখছে, সেটিই বাস্তব চাকরির প্রয়োজন মেটায়। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়।

Dual Education System-এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো- এটি শিক্ষার্থীদের 'career readiness' তৈরি করে। শিক্ষার্থীরা এখানে শুধু বই পড়ে না, বরং বাস্তব সমস্যার সমাধান শেখে। তারা অফিস বা কারখানার বাস্তব পরিস্থিতিতে কাজ করে, সিদ্ধান্ত নেয়, ভুল করে, আবার শেখে, যা ক্লাসরুমের বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত শিক্ষা। এর পাশাপাশি, তারা মাসিক স্টাইপেন্ডও পায় (সাধারণত ৮০০–১২০০ ইউরো পর্যন্ত), যা শেখার আগ্রহ ও দায়িত্ববোধ দুটোই বাড়ায়।

জার্মানির এই সাফল্য দেখে অনেক দেশ, যেমন- অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া,নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একই মডেল গ্রহণ করেছে।বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এই মডেলের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, কারণ এটি তরুণদের চাকরিযোগ্য করে তুলতে কার্যকর। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন UNESCO ও ILO এই পদ্ধতিকে উন্নয়নশীল দেশের "Future-ready Education Model" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

জার্মানির Dual Education System প্রমাণ করে, শিক্ষা তখনই পূর্ণতা পায় যখন তা বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এখানে শিখন মানে শুধু পরীক্ষা নয়, বরং জীবনের জন্য প্রস্তুতি। যখন শেখা আর কাজ একসাথে চলে, তখনই তৈরি হয় দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্ববান মানুষ। 

আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যেখানে চাকরি পরিবর্তিত হচ্ছে প্রযুক্তির গতিতে, সেখানে এই মডেলই হতে পারে ভবিষ্যৎ শিক্ষার সেতুবন্ধন-শিক্ষা থেকে কর্মসংস্থান পর্যন্ত এক অবিচ্ছেদ্য যাত্রা। ডিগ্রির চেয়ে দক্ষতা—এই দর্শনেই দাঁড়িয়ে আছে জার্মানির সফল শিক্ষা মডেল।

 

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ