মাথা কাজ করছে না, মন অগোছালো?-এটাই কি ব্রেইন ফগ? জানুন কারণ ও সমাধান!

মাথা কাজ করছে না, মন অগোছালো?-এটাই কি ব্রেইন ফগ? জানুন কারণ ও সমাধান!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

কখনও কি মনে হয়, মাথার ভেতর কুয়াশা জমে গেছে? কথার মাঝপথে হঠাৎ থেমে যাচ্ছেন, সাধারণ বিষয়ও মনে থাকছে না, কিংবা পরিচিত রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, 'আমি এখানে কেন এসেছি?' এই বিভ্রান্তি, মনোযোগের ঘাটতি, স্মৃতিশক্তির ঝাপসা ভাব, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থার নামই ব্রেইন ফগ। এটি কোনো রোগ নয়, বরং মস্তিষ্কের ক্লান্তির এক সূক্ষ্ম সংকেত। যেমন: শরীর অতিরিক্ত কাজের পর বিশ্রাম চায়, তেমনি মস্তিষ্কও কখনো কখনো জানিয়ে দেয়, "আমারও বিশ্রাম দরকার।"

ব্রেইন ফগ আসলে কীভাবে কাজ করে?

ব্রেইন ফগের সময় মস্তিষ্কে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ (information processing) ধীর হয়ে যায়।নিউরনের মধ্যে যে দ্রুত বৈদ্যুতিক সংকেত আদান-প্রদান হয়, সেটি তখন মন্থর হয়ে পড়ে। ফলে মনোযোগ, স্মৃতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-সবই প্রভাবিত হয়। নিউরোসায়েন্সে দেখা গেছে, যখন কর্টিসল নামের স্ট্রেস হরমোন দীর্ঘসময় ধরে শরীরে থেকে যায়, তখন এটি হিপোক্যাম্পাস, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ও অ্যামিগডালা-এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে প্রভাব ফেলে।

হিপোক্যাম্পাস, স্মৃতিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। অতিরিক্ত কর্টিসল এ অঞ্চলের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।আমাদের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স- চিন্তা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্র। এটি অতিরিক্ত চাপের সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আবার মস্তিষ্কের  অ্যামিগডালা অংশ,  ভয় ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি অতিসক্রিয় হয়ে গেলে ছোট সমস্যা বড় মনে হয়।ফলে মানুষ সবকিছু একসাথে চিন্তা করতে গিয়ে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে, মাথা ভার লাগে, চিন্তা ঘোলাটে হয়ে যায়।
 

কেন হয় ব্রেইন ফগ?

ব্রেইন ফগের পেছনে একাধিক জৈবিক, মানসিক ও জীবনযাপন-সংক্রান্ত কারণ কাজ করে।

১️/ মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: দীর্ঘদিনের স্ট্রেস কর্টিসলের মাত্রা বাড়ায়। এই হরমোন মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয়, ফলে নিউরনের মধ্যে যোগাযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে।

২️/ ঘুমের ঘাটতি: ঘুমের সময় মস্তিষ্কে জমে থাকা অ্যামাইলয়েড বেটা নামক বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার হয়। ঘুমের অভাবে এই পদার্থ জমে থেকে মস্তিষ্কের কোষগুলিকে ধীর করে দেয়, যার ফলে ব্রেইন ফগ দেখা দেয়।

৩️/ অপুষ্টি ও পানিশূন্যতা: ভিটামিন বি১২, আয়রন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বা কোলিনের ঘাটতি মস্তিষ্কের স্নায়ুবিক কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে।
একইভাবে শরীরে পানি কমে গেলে নিউরন সংকেত পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে মনোযোগ কমে যায়।

৪️/ হরমোনের ওঠানামা: বিশেষ করে মেনোপজ ও পেরিমেনোপজ-এর সময় ইস্ট্রোজেনের ভারসাম্য নষ্ট হলে ব্রেইন ফগের প্রবণতা বাড়ে। ইস্ট্রোজেন হিপোক্যাম্পাসে স্নায়ুর কার্যক্রম বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৫️/ ভাইরাল সংক্রমণ বা অসুস্থতা পরবর্তী ধাপ: অনেকেই করোনা-পরবর্তী সময়ে "লং কোভিড ব্রেইন ফগ"-এর কথা জানিয়েছেন। ভাইরাস-জনিত প্রদাহ (inflammation) নিউরনের স্বাভাবিক সংকেত আদান-প্রদানে বাধা দেয়।

৬️/ ডিজিটাল ওভারলোড: অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম, অর্থাৎ টানা মোবাইল, কম্পিউটার বা টিভি ব্যবহারে মস্তিষ্কের ডোপামিন রিসেপ্টর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়, মনে হয় চিন্তাগুলো কুয়াশার মতো।

 

মস্তিষ্কের ক্লান্তির লক্ষণ:

ব্রেইন ফগের সময় যে পরিবর্তনগুলো হয়-

⇨ মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা

⇨ হঠাৎ ভুলে যাওয়া বা কথায় আটকে যাওয়া

⇨ সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগা

⇨ মাথা ভারী, ঝাপসা বা শূন্য লাগা

⇨ দৈনন্দিন কাজেও মানসিক ক্লান্তি

⇨ আবেগীয় অস্থিরতা বা সহজে রেগে যাওয়া

এই লক্ষণগুলো যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এটি মস্তিষ্কের অতিরিক্ত চাপের সংকেত।
 

ব্রেইন ফগ কমানোর কার্যকর উপায়:

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রেইন ফগ থেকে মুক্তি পেতে জীবনযাত্রার ক্ষুদ্র পরিবর্তনই বড় প্রভাব ফেলতে পারে। ব্রিটিশ মনোচিকিৎসক ডা. থারাকা চারটি সহজ টিপস দিয়েছেন-

১. নিজের প্রতি সদয় হোন। এটি ব্যর্থতার চিহ্ন নয়, বরং শরীরের ভাষায় বলা একটি সংকেত- 'আমি ক্লান্ত।' নিজেকে বিশ্রাম দিন, সময় দিন। কাজ ভাগ করে নিন, পারলে সাহায্য চান।

২. রুটিন তৈরি করুন। অযথা 'কি করব' ভাবনা থেকে মস্তিষ্ককে বাঁচান। সকালে পরার পোশাক, নাশতা, বা দিনের কাজের তালিকা আগেই নির্ধারণ করুন। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপ কমে যায়।

৩. বিরতি নিন। টানা কাজ বা পড়াশোনা মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমায়। প্রতি এক ঘণ্টা পর অন্তত ৫–১০ মিনিটের বিরতি নিন—হাঁটুন, পানি পান করুন বা শুধু চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন।

৪. প্রযুক্তিকে ব্যবহার করুন, নির্ভরতা নয়! সবকিছু মনে রাখার চাপে মাথা ভার করবেন না। ক্যালেন্ডার, রিমাইন্ডার বা টু-ডু অ্যাপ ব্যবহার করুন, যাতে মস্তিষ্ক অপ্রয়োজনীয় তথ্য ধরে রাখার বোঝা থেকে মুক্ত থাকে।

 

ব্রেইন ফগ প্রতিরোধে ডা. থারাকা একটি কার্যকর সূত্র প্রস্তাব করেছেন - SWAANS, যা সহজভাবে মনে রাখা যায়, আবার বৈজ্ঞানিকভাবেও কার্যকর।

➤  S — Sleep (ঘুম):প্রতিদিন ৭–৯ ঘণ্টা ঘুম নিউরন পুনর্গঠনে সাহায্য করে। ঘুমের সময় মস্তিষ্কের গ্লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করে।

➤  W — Water (পানি):শরীরের পানিশূন্যতা ব্রেনের বৈদ্যুতিক কার্যক্রমে বাধা দেয়। প্রতি ঘণ্টায় অল্প পানি পান মস্তিষ্কের পারফরম্যান্স বাড়ায়।

➤ A — Activity (শারীরিক পরিশ্রম): হাঁটা, দৌড়ানো বা হালকা ব্যায়াম মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়, নতুন নিউরন তৈরিতে সহায়তা করে।

➤ A — Attention to Nutrition (পুষ্টি): ডিম, বাদাম, মাছ ও সবুজ শাকসবজি কোলিন, ওমেগা-৩ ও ভিটামিন সমৃদ্ধ, যা নিউরন মেরামতে সহায়তা করে।

➤ N — No Stress (চাপ নিয়ন্ত্রণ): দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ কর্টিসল বাড়িয়ে নিউরন ক্ষতি করে। তাই মেডিটেশন, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস বা শখের কাজে সময় দিন।

➤ S — Self-care (নিজেকে যত্ন): সামাজিক সম্পর্ক, প্রিয় কাজ বা প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকা মস্তিষ্কের আবেগীয় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।

 

বিভিন্ন নিউরোসায়েন্টিফিক গবেষণায় দেখা গেছে-

নিয়মিত ব্যায়াম করলে ব্রেইন ডেরাইভড নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর (BDNF) নামের প্রোটিন বৃদ্ধি পায়, যা নতুন নিউরন তৈরি করে ও স্মৃতি উন্নত করে। পুষ্টিকর খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্ট্রেস-ম্যানেজমেন্ট একসঙ্গে মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ায়-অর্থাৎ মস্তিষ্ক নিজেকে পুনর্গঠন করতে পারে।মেডিটেশন করলে অ্যামিগডালার অতিসক্রিয়তা কমে, কর্টিসল কমে যায় এবং মস্তিষ্কে শান্ত ভাব তৈরি হয়।

ব্রেইন ফগ আমাদের আধুনিক জীবনের এক বাস্তব সংকেত। ব্যস্ততা, উদ্বেগ, ঘুমহীনতা, অতিরিক্ত তথ্যচাপ, সবকিছু মিলে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সুখবর হলো, মস্তিষ্ক নিজেকে পুনরুদ্ধার করার অসাধারণ ক্ষমতা রাখে। নিয়মিত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত পানি, ব্যায়াম ও মানসিক প্রশান্তির চর্চা—এই পাঁচটি অভ্যাস যদি জীবনের অংশ হয়, তবে সেই কুয়াশা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে। চিন্তার আকাশ আবার পরিষ্কার হবে, মস্তিষ্ক ফিরে পাবে তার প্রাকৃতিক স্বচ্ছতা, মনোযোগ আর প্রাণশক্তি।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ