ইউরোপিয়ানদের দীর্ঘ জীবন আর তরুণ ত্বকের রহস্য লুকিয়ে এই এক ডায়েটে!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ইউরোপের দক্ষিণ উপকূলীয় দেশগুলোর দিকে তাকালে এক অদ্ভুত বিষয় চোখে পড়ে, সেখানকার মানুষদের গড় আয়ু তুলনামূলক বেশি, হৃদরোগের হার অনেক কম, আর তাদের মুখে থাকে এক ধরনের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা ও প্রশান্তি। প্রশ্ন উঠেছে- এর পেছনের রহস্য কী? ডাক্তাররা, গবেষকরা এবং পুষ্টিবিদরা একমত- এই রহস্য লুকিয়ে আছে তাঁদের প্রতিদিনের খাবার ও জীবনযাত্রায়, যা পরিচিত "Mediterranean Diet" নামে।
এটি শুধু একটি ডায়েট নয়, বরং এক ধরনের সংস্কৃতি। যেখানে খাবার, ব্যায়াম, বিশ্রাম ও সামাজিক জীবন মিলে তৈরি করে এক ভারসাম্যপূর্ণ জীবনধারা। চলুন জেনে নেওয়া যাক, কেন এই ডায়েটকে বলা হয় "সুস্বাদু সুস্থতার সূত্র" এবং কীভাবে এটি আমাদেরও দীর্ঘায়ু ও সুস্থতার পথে নিয়ে যেতে পারে।
Mediterranean Diet–এর জন্ম হয় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে। বিশেষ করে গ্রিস, ইতালি, স্পেন ও দক্ষিণ ফ্রান্সে।১৯৫০–এর দশকে আমেরিকান গবেষক আনসেল কিজ এই অঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রা ও হৃদরোগের সম্পর্ক নিয়ে বিশদ গবেষণা করেন।তিনি লক্ষ্য করেন, এই দেশগুলোর মানুষরা প্রচুর চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার পরও তাঁদের রক্তচাপ কম, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রিত এবং হৃদরোগের হার আশ্চর্যজনকভাবে কম।পরবর্তীতে "Seven Countries Study" নামে পরিচিত এই গবেষণায় দেখা যায়, এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যরহস্য লুকিয়ে আছে তাঁদের খাদ্যাভ্যাসে, যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে উদ্ভিজ্জ উপাদান, প্রাকৃতিক ফ্যাট, মাছ, ফল, শাকসবজি এবং সুষম পরিমাণে শস্য। এরপর থেকেই সারা বিশ্বে Mediterranean Diet হয়ে ওঠে "Heart-Healthy Eating Pattern"–এর প্রতীক।
Mediterranean Diet আসলে কী?
এই ডায়েটের কোনো কঠোর নিয়ম বা নির্দিষ্ট ক্যালোরি গণনা নেই।এটি মূলত প্রকৃতির কাছাকাছি, অপরিশোধিত, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার একটি জীবনধারা। মূল উপাদানগুলো হলো -
১। অলিভ অয়েল (Olive Oil): এই তেলের মধ্যে রয়েছে মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা রক্তনালিকে সুরক্ষা দেয় এবং খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়।
২। রঙিন ফল ও সবজি: প্রতিদিনের খাবারের মূল অংশ গঠন করে টমেটো, ক্যাপসিকাম, পেঁপে, গাজর, পাতা শাক ইত্যাদি। এসব খাবারে ভিটামিন–সি, বিটা–ক্যারোটিন ও ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে, যা শরীরে ফ্রি–র্যাডিকেল প্রতিরোধ করে কোষকে তরুণ রাখে।
৩। পূর্ণ শস্য ও ডালজাতীয় খাদ্য: যেমন ওটস, বার্লি, কুইনোয়া, ব্রাউন রাইস, ছোলা ও মসুর ডাল। এগুলো ধীরে হজম হয়, রক্তে শর্করার ভারসাম্য রাখে ও দীর্ঘসময় পেট ভরা অনুভূতি দেয়।
৪। মাছ ও সামুদ্রিক খাবার: বিশেষ করে স্যামন, টুনা, সার্ডিন, ম্যাকারেল- এগুলোতে ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা প্রদাহ কমায় এবং হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
৫। বাদাম, বীজ ও হার্বস: আমন্ড, আখরোট, চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিড, বাসিল, থাইম, রোজমেরি- এসব শুধু স্বাদ বাড়ায় না, বরং শরীরে ম্যাগনেশিয়াম ও প্রাকৃতিক ফ্যাট যোগায়।
৬। ডেইরি ও প্রোটিন: প্রতিদিন নয়, কিন্তু মাঝেমাঝে দই বা সামান্য চিজ থাকে খাদ্যতালিকায়; যা প্রোবায়োটিকের মাধ্যমে হজমে সহায়তা করে। লাল মাংস মাসে এক-দু'বারের বেশি খাওয়া হয় না।
Mediterranean Diet হৃদযন্ত্রের সুরক্ষায় অনন্য।এটি কেবল কম তেল বা কম ক্যালোরিই নয়; বরং এটি শরীরের প্রদাহ কমিয়ে রক্তনালির নমনীয়তা বৃদ্ধি করে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাগুলো যা বলছে-
New England Journal of Medicine (2013)–এর এক গবেষণায় দেখা যায়, এই ডায়েট অনুসরণকারীদের মধ্যে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে প্রায় ৩০% পর্যন্ত।
American Heart Association (AHA) জানিয়েছে, এই খাদ্যপদ্ধতি রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
Harvard School of Public Health বলছে, যারা Mediterranean Diet নিয়মিত অনুসরণ করেন, তাঁদের আয়ু গড়ে অন্যদের তুলনায় ৪–৬ বছর বেশি।
এই ডায়েট মূলত শরীরে "Anti-inflammatory Effect" তৈরি করে। অর্থাৎ, শরীরের কোষগুলোতে যে নীরব প্রদাহ (Silent Inflammation) তৈরি হয়, যা বয়স বাড়া, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস বা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়, তা নিয়ন্ত্রণে রাখে এই খাবার পদ্ধতি।
মস্তিষ্ক, মুড ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় ভুমিকা-
Mediterranean Diet শুধু শরীর নয়, মনকেও প্রভাবিত করে।গবেষণায় দেখা গেছে, এই খাদ্যাভ্যাস ডিপ্রেশন ও উদ্বেগ কমাতে কার্যকর।ওমেগা–৩, বি–ভিটামিন, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট–সমৃদ্ধ খাবার নিউরনের কার্যক্রম উন্নত করে এবং "সেরোটোনিন" নামক সুখ–হরমোনের মাত্রা বাড়ায়।একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত এই ডায়েট অনুসরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে আলঝেইমার ও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি ৩০–৪০% কম।কারণ এটি মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় এবং কোষের অবক্ষয় ঠেকায়।
এই ডায়েটকে বোঝার জন্য দরকার তাঁদের জীবনযাত্রা বোঝা। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মানুষ খাবারকে উৎসব মনে করে। তারা পরিবারের সঙ্গে বসে ধীরে ধীরে খায়, মনোযোগ দিয়ে চিবিয়ে স্বাদ নেয়,প্রতিদিন হাঁটে বা হালকা ব্যায়াম করে,দুপুরে ছোট্ট বিশ্রাম (Siesta) নেয়, এবং রাতে পর্যাপ্ত ঘুমে শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করে। অর্থাৎ, তাদের জীবনযাত্রা স্ট্রেসমুক্ত, ছন্দময় এবং সামাজিকভাবে সক্রিয়।এটাই এই ডায়েটের আসল শক্তি ।
বাংলাদেশি উপায়ে যেভাবে অনুসরণ করা যায়-
আপনি চাইলে স্থানীয় উপকরণ দিয়েই এই ডায়েট অনুসরণ করতে পারেন -
☞ রান্নায় অলিভ অয়েল বা সরিষার তেল ব্যবহার করুন, তবে অতিরিক্ত নয়।
☞ প্রতিদিন ৫–৬ রঙের ফল ও সবজি রাখুন মেনুতে।যেমন- টমেটো, গাজর, পালং, বেগুন, কলা, কমলা ইত্যাদি।
☞ সাদা চালের বদলে ব্রাউন রাইস বা ওটস ব্যবহার করুন।
☞ সপ্তাহে ৩ দিন মাছ বা ডালজাতীয় প্রোটিন খান।
☞ বাদাম, চিয়া সিড বা তিল প্রতিদিনের খাবারে অল্প পরিমাণে যোগ করুন।
☞ এবং অবশ্যই ধীরে, মনোযোগ দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। খাওয়ার সময় ফোন বা টিভি বন্ধ রাখুন।
Mediterranean Diet জানায় সুস্থতা মানে শুধু ওজন কমানো নয়; বরং নিজের শরীর, মন ও সময়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। এখানে নিষেধের চেয়ে অনুমোদনের পরিমাণ বেশি। স্বাদ, রঙ, গন্ধ, পুষ্টি সবই আছে, শুধু পরিমিতি ও সচেতনতার সঙ্গে। এই ডায়েট মানুষকে শুধু রোগমুক্ত রাখে না, বরং তাদের জীবনের মানও উন্নত করে।তাই, বয়স যাই হোক না কেন, যদি আপনি চান সুস্বাদু খাবার খেয়ে দীর্ঘায়ু, প্রাণবন্ত ও হৃদবান্ধব জীবন, তবে মেডিটেরেনিয়ান ডায়েট হতে পারে আপনার প্রতিদিনের নীরব কিন্তু শক্তিশালী সঙ্গী।
ভালো খাবার শুধু শরীর নয়, মনকেও নিরাময় করে। আর সেই নিরাময়ের সবচেয়ে প্রাকৃতিক পথই হলো-Mediterranean Diet.
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।