বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ১০টি ভূমিকম্প

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ১০টি ভূমিকম্প
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলাদেশ ভূমিকম্প–ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ভারতীয় ও বার্মিজ টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করায় এই অঞ্চলে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত কয়েক শতাব্দীতে বাংলাদেশ ও এর আশপাশে অন্তত ১০টি ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে, যেগুলোর প্রভাব দেশের জনজীবন, অবকাঠামো ও ভূপ্রকৃতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। এসব তথ্য বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (USGS) এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভূমিকম্প গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ‘গ্রেট আসাম আর্থকোয়েক’ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম বড় ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.১। এ কম্পন মেঘালয় থেকে সিলেট, শিলং পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পুরোনো স্থাপনা ও রাস্তাঘাটে ব্যাপক ক্ষতি করে। এরপর ১৯১৮ সালে বিরাট ভূমিকম্পে মানিকগঞ্জসহ দেশের পশ্চিম অঞ্চলে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট ভেঙে পড়ে। ১৯২৩ সালের ভোলা ভূমিকম্পও উপকূলীয় অঞ্চলে বড় ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছিল।

১৯৩০ সালে মেঘালয়ের ধুবড়ি অঞ্চলে সংঘটিত ভূমিকম্পে সিলেট ও ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘরবাড়ি ধসে পড়ে। ১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল ৮.৬। প্রবল ভূমি দোলনের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বহু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংঘটিত মাঝারি মাত্রার কম্পনে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের ঘটনা ঘটে।

২০০৩ সালে সিলেট-ময়মনসিংহ অঞ্চলে কয়েক দফা ভূমিকম্পে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে কাঁপন ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায়, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়; তখন বহু ভবনে ফাটল দেখা দেয়। ২০১৬ সালের সিলেট ভূমিকম্পের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভবনগুলোর কাঠামোগত সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা শুরু করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ২০২১, ২০২৩ এবং ২০২৫ সালের কয়েকটি কম্পন দেশব্যাপী সতর্কতা বাড়িয়েছে, যদিও ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম ছিল।

সর্বশেষ গতকাল ২১ নভেম্বর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অনুভূত ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে সারাদেশে মোট ১০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে, আহত হয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক। অসংখ্য স্থাপনা ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ভূমিকম্পে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে সর্বোচ্চ। নরসিংদীর মাধবদীতে উৎপত্তি এই ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে নরসিংদী ও রাজধানী ঢাকায়। বংশালের কসাইটুলী এলাকায় একটি পাঁচতলা ভবনের রেলিং নিচে পড়ে বাবা-ছেলে হাজি আব্দুল রহিম (৪৭) ও মেহরাব হোসেন রিমন (১৩) এবং সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র রাফি নিহত হন। রাফির মা নুসরাত গুরুতর আহত। মুগদার মদিনা বাগ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের রেলিং ধসে পড়ে নিরাপত্তাকর্মী মাকসুদ (৫০) মারা যান।

ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে টিনশেড ঘরের দেয়াল ধসে এক বছর বয়সি শিশু ফাতেমা নিহত হয়; তার মা ও আরেক প্রতিবেশী আহত। নরসিংদী সদর উপজেলার গাবতলীতে সানশেড ভেঙে শিশুসহ বাবা-ছেলে ওমর (১০) এবং দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল নিহত হন। পলাশ উপজেলার মালিতা গ্রামে মাটির ঘর ধসে কাজেম আলী ভূঁইয়া (৭৫) এবং কাজীরচরে নাসির উদ্দিন (৬৫) ও শিবপুরের আজকীতলায় ফোরকান মিয়া (৪৫) প্রাণ হারান।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইতিহাসের এসব বড় ঘটনার পরও বাংলাদেশে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী স্থাপনা নির্মাণে সামগ্রিক অগ্রগতি এখনও ধীর। রাজধানী ঢাকার ঘনবসতি, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও পুরোনো অবকাঠামোর কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই গেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং আন্তর্জাতিক ভূ-গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একাধিক বিশ্লেষণে বলা হয়, দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান ভবিষ্যতেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি বহন করে।

গবেষকরা উল্লেখ করেন, ভূমিকম্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অঞ্চলটিতে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ বছরের ব্যবধানে বড় মাত্রার কম্পন হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। ফলে অতীতের ভয়াবহ দশ ঘটনার অভিজ্ঞতা বর্তমানের প্রস্তুতিকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, জরুরি উদ্ধার সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভবন কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং জনসচেতনতা উন্নত করা, এসবই সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ। 

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ