বিশ্রামের শক্তি জানুন, জীবন বদলান-'Rest Is Resistance'জানাচ্ছে অজানা সত্য!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের পৃথিবীতে, যেখানে 'ব্যস্ত থাকা' মানেই সফলতার প্রতীক, সেখানে বিশ্রাম যেন অপরাধবোধের আরেক নাম। "সময় নষ্ট করা যাবে না"-এই চিন্তা প্রতিদিন মানুষকে ক্লান্ত, শূন্য আর মানসিকভাবে অবসন্ন করে তুলছে। এমন সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ট্রিসিয়া হারসি তাঁর বই "Rest Is Resistance: A Manifesto"-তে বলেছেন এক যুগান্তকারী কথা-"বিশ্রামই এক রাজনৈতিক, মানসিক ও সামাজিক প্রতিরোধ।"
প্রতিদিনের জীবন যেন একটি অবিরাম দৌড়, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে প্রতিযোগিতা। কর্পোরেট জগৎ থেকে সামাজিক মাধ্যম পর্যন্ত সর্বত্র একই বার্তা: "আরও করো, আরও দাও, আরও অর্জন করো।"
এই মানসিক চাপ তৈরি করেছে তথাকথিত "hustle culture" যেখানে বিশ্রাম মানেই অলসতা, আর শান্ত থাকা মানেই পিছিয়ে পড়া।কিন্তু ট্রিসিয়া হারসি প্রশ্ন তোলেন, "মানুষ যদি সারাক্ষণ মেশিনের মতো কাজ করে, তবে তার আত্মা কোথায় হারিয়ে যায়?"তিনি মনে করিয়ে দেন, প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দ আছে- দিন ও রাত, জোয়ার ও ভাটা, ঋতুর পরিবর্তন। প্রকৃতি যেমন বিশ্রাম নেয়, তেমনই মানুষও বিশ্রামের মাধ্যমে পুনর্জীবিত হয়। এই প্রাকৃতিক চক্রকে উপেক্ষা করা মানে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া।
বিশ্রাম শুধু মানসিক শান্তি দেয় না, এটি আমাদের শরীরের রাসায়নিক ভারসাম্যও রক্ষা করে।নিউরোসায়েন্টিস্টদের মতে, ঘুমের সময় মস্তিষ্ক 'গ্লিম্ফাটিক সিস্টেম'-এর মাধ্যমে টক্সিন বা বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে সেই বর্জ্য জমে থেকে স্মৃতিশক্তি দুর্বল করে, মনোযোগ নষ্ট করে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা তৈরি করে। একইসঙ্গে, যখন আমরা কিছু করছি না, তখন মস্তিষ্কের Default Mode Network সক্রিয় হয়। এই সময়েই মস্তিষ্ক নতুন ধারণা তৈরি করে, অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে, এবং সৃষ্টিশীল চিন্তার জন্ম দেয়।অর্থাৎ, বিশ্রাম মানে কাজের বিরতি নয়, বরং মস্তিষ্কের গভীর কাজ করার সময়। মনোবিজ্ঞানীরা আরও বলেন— নিয়মিত বিশ্রাম মানসিক ক্লান্তি, উদ্বেগ, হতাশা ও 'বার্নআউট সিনড্রোম'-এর বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক।
ট্রিসিয়া হারসির ভাবনার শিকড় আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাসে। দাসপ্রথার যুগে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের দিন-রাত নিরবচ্ছিন্ন শ্রম দিতে হতো; বিশ্রাম ছিল নিষিদ্ধ।হারসি সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখান, বিশ্রাম নেওয়া আসলে একপ্রকার বিদ্রোহ। তিনি বলেন— "আমাদের শরীর, সময়, এবং নিঃশ্বাস আমাদের নিজের। আমরা যখন বিশ্রাম নিই, তখনই এই অধিকারটি পুনরুদ্ধার করি।"তাঁর এই দর্শন শুধু অতীতের নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া নয়, এটি আধুনিক সমাজের উৎপাদনভিত্তিক দমননীতির বিরুদ্ধেও এক প্রতীকী প্রতিবাদ।আজও যখন অবিরাম ব্যস্ত থাকা কে গৌরব হিসেবে দেখা হয়, তখন বিশ্রাম নেওয়া এক নীরব বিপ্লব, নিজের অস্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ।
হারসি তুলে ধরেছেন যে, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে একজন মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয় তার কাজের পরিমাণ ও উৎপাদনক্ষমতা দিয়ে।স্কুল থেকে অফিস সব জায়গায় শিখিয়ে দেওয়া হয়, কাজ করলেই আপনি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে শুধু 'পারফরম্যান্স' দিয়ে মাপতে শেখে। এই মানসিক কাঠামো তৈরি করেছে এক প্রকার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খল,যেখানে বিশ্রাম নেওয়ার সাহসও লাগে।হারসি এই শৃঙ্খল ভাঙতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, "তুমি যদি একটু বিশ্রাম নাও, তবেই তোমার মন নতুন করে ভাবতে শিখবে।"এই ভাবনা শুধু ব্যক্তিগত নয়; এটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের প্রতীক।
বইটিতে হারসি বিশ্রামকে কেবল ঘুম বা নীরবতা হিসেবে নয়, বরং এক আত্মিক সংলাপ হিসেবে দেখেছেন।যখন আমরা থেমে যাই, তখনই শুনতে পাই নিজের ভেতরের কণ্ঠ,যে কণ্ঠ আমাদের প্রকৃত চাহিদা, ভয়, ক্লান্তি ও আনন্দের উৎস জানায়।ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির দিক থেকেও বিশ্রাম গভীর তাৎপর্য বহন করে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোয় Sabbath বা Day of Rest ছিল আত্মা ও সমাজের ভারসাম্য রক্ষার অংশ।আজকের দুনিয়ায় এই প্রথা হারিয়ে গেলেও তার প্রয়োজন আরও বেড়েছে। কারণ, আধুনিক মানুষ ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে নিজের ভেতর থেকে।
বিশ্রামকে হারসি এক ধরনের "র্যাডিকাল সেলফ-কেয়ার" বলে অভিহিত করেন, যা নিজের প্রতি সম্মান জানানোর একটি কার্যকর উপায়।যখন আমরা বিশ্রাম নিই, তখন আমরা নিজের শরীরের সংকেত শুনি- এটি আমাদের শেখায় -কখন থামতে হবে। এভাবে বিশ্রাম একদিকে যেমন মানসিক সুস্থতা আনে, অন্যদিকে সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তিনি বলেন, "একটি সমাজ যদি মানুষকে এমনভাবে ব্যস্ত রাখে যে তারা নিজের ক্লান্তি পর্যন্ত অনুভব করতে না পারে, তবে সেই সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজন।"এই বই তাই কেবল আত্মোন্নয়নের গাইড নয়,এটি এক সামাজিক মেনিফেস্টো, যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় বিশ্রাম কোনো বিলাসিতা নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের অধিকার।
"Rest Is Resistance" আমাদের শেখায়, জীবনের সবচেয়ে বড় সাহস হলো কিছু সময়ের জন্য থেমে যাওয়া। যখন পুরো পৃথিবী বলছে "দৌড়াও", তখন শান্তভাবে বসে নিঃশ্বাস নেওয়া একধরনের বিপ্লব।বিশ্রাম আমাদের মানবিক করে তোলে, সৃষ্টিশীল রাখে, আর শেখায় যে উৎপাদনের বাইরে জীবনও আছে। কারণ, যে সমাজ বিশ্রামের মূল্য বোঝে না, সে সমাজ শেষ পর্যন্ত নিজেকেই ক্লান্ত করে ফেলে।আর যে মানুষ বিশ্রামকে প্রতিরোধে পরিণত করতে জানে, সে-ই প্রকৃত অর্থে মুক্ত।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।