ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোমে ভুগছেন না তো?-চিকিৎসক বলছেন ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম সম্পর্কে, যা জানা জরুরি!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ভালোবাসার সম্পর্ক ভাঙা, প্রিয়জনকে হারানো, আকস্মিক দুঃসংবাদ পাওয়া, ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা দেখা, কিংবা এমনকী প্রচণ্ড আনন্দ - এই সবই মানুষের মনে ঝাঁকুনি সৃষ্টি করে। কিন্তু সেই মানসিক ঝাঁকুনি যে শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হৃদযন্ত্রে সরাসরি আঘাত হানতে পারে, তা অনেকে কল্পনাও করেন না। বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা যে অবস্থাকে ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে বলা হয় স্ট্রেস-ইনডিউসড কার্ডিওমায়োপ্যাথি। নাম শুনে রোমান্টিক মনে হতে পারে, কিন্তু এর বাস্তবতা কঠোর ও ভয়াবহ। এই রোগের বৈশিষ্ট্য এতটাই বিভ্রান্তিকর যে মানুষ প্রায়ই বুঝতেই পারে না এটি হৃদরোগ নয়, বরং মানসিক আঘাতের শারীরিক প্রতিক্রিয়া।
মানবদেহে যখন ভয় বা শোকের মতো প্রবল আবেগ জন্মায়, তখন মস্তিষ্ক মনে করে শরীর সংকট অবস্থায় রয়েছে। ফলে স্নায়ুতন্ত্র দ্রুত শরীরে অ্যাড্রেনালিন, নর-অ্যাড্রেনালিনসহ বিভিন্ন স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এই হরমোনগুলো সাধারণত জরুরি অবস্থায় আমাদের শরীরকে সাহায্য করে- বাঁচতে দৌড়ানো, বিপদ থেকে বের হওয়া, বা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এগুলো উপকারী। কিন্তু মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে সমস্যা শুরু হয়। অ্যাড্রেনালিন সরাসরি হৃদপেশির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে-
◑ হৃদপেশি তাৎক্ষণিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে
◑ রক্তসঞ্চালনের স্বাভাবিক ছন্দ বিঘ্নিত হয়
◑ হৃদযন্ত্রের বাম নিলয় (Left Ventricle) অস্বাভাবিক আকার ধারণ করতে পারে
◑ ক্যালসিয়াম আদান–প্রদানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়
◑ স্নায়ুতন্ত্র হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত উত্তেজিত করে তোলে। ফলে হৃদপিণ্ডের পাম্পক্ষমতা হ্রাস পায়, এবং এটি যেন সাময়িকভাবে "শক" খেয়ে পড়ে।
চিকিৎসাজগতে এটিকে বলা হয় টেম্পোরারি কার্ডিয়াক ডিসফাংশন। অর্থাৎ হৃদযন্ত্র কিছু সময়ের জন্য কাজ করার ক্ষমতা হারায়।
কেন লক্ষণগুলো ঠিক হার্ট অ্যাটাকের মতো দেখায়?
এটি সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি। ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম সৃষ্টি হলেও হৃদযন্ত্রের রক্তনালিতে ব্লক থাকে না, অর্থাৎ এটি হার্ট অ্যাটাক নয়। কিন্তু স্ট্রেস হরমোন যখন হৃদপেশিকে দুর্বল করে, তখন তার প্রতিক্রিয়া হার্ট অ্যাটাকের মতোই হয়—
⇨ বুকের তীব্র ব্যথা
⇨ শ্বাস নিতে সমস্যা
⇨ ঘাম ঝরা
⇨ বুকে চাপ অনুভব
⇨ মাথা ঘোরা
⇨ মৃদু অজ্ঞান বোধ
এসবই রোগীকে ভুল ধারণায় ফেলতে পারে।
চিকিৎসকেরা বলেন, মানসিক আঘাতের পর হঠাৎ বুক ব্যথা হলে সেটা কখনোই অবহেলা করা যাবে না, কারণ এই সিনড্রোমের সময় হৃদযন্ত্র ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে না পারলে বড় জটিলতা তৈরি হতে পারে।
কে এই ঝুঁকিতে বেশি?-
ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম যেকারো পক্ষেই হতে পারে। তবে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়-
১. নারীরা (বিশেষ করে ৪৫–৭০ বছর বয়সী): হরমোনগত পরিবর্তন, স্ট্রেস রেসপন্স সিস্টেমে পার্থক্য, ও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ-সব মিলিয়ে নারীদের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি দেখা যায়।
২. দীর্ঘদিন চাপগ্রস্ত মানুষ: যাদের জীবনধারা, কর্মক্ষেত্র বা সম্পর্ক চাপপূর্ণ-তাদের শরীরের স্ট্রেস রেসপন্স ব্যবস্থা আগে থেকেই দুর্বল, ফলে ধাক্কার সময় ঝুঁকি বাড়ে।
৩. শোক বা ট্রমা–অভিজ্ঞ ব্যক্তি: কারো মৃত্যু, সম্পর্কভাঙন, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বড় আর্থিক ক্ষতি-এসব গভীর মানসিক আঘাতকে কেন্দ্র করে সিনড্রোম দেখা দিতে পারে।
৪. পূর্বে হৃদযন্ত্র দুর্বলতা থাকা ব্যক্তি: এদের ক্ষেত্রে স্ট্রেসের তীব্র প্রতিক্রিয়া হৃদপেশিকে আরও দুর্বল করে দেয়।
আবেগ কি সত্যিই হৃদযন্ত্রের গঠন বদলে দেয়!
মনের ব্যথা কি সত্যিই হৃদপিণ্ডকে "ভেঙে" দিতে পারে?
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উত্তরে 'হ্যাঁ'। কারণ:
◑ হৃদপেশি কাঠামোগতভাবে ফোলা বা দুর্বল হতে পারে
◑ ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালিং ব্যাহত হয়
◑ পাম্পিং ক্ষমতা ৩০–৫০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে
◑ হার্টের স্থায়ী পরিবর্তন না হলেও সাময়িক বিকলতা ঘটতে পারে
অর্থাৎ, শোক বা ভয়ের ধাক্কায় হৃদযন্ত্র সাময়িকভাবে নিজের স্বাভাবিক আকার–ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, যা কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে।
চিকিৎসকের সতর্কবার্তা-
যদি কোনো মানসিক আঘাত বা শক্তিশালী আবেগিক ঘটনার পর দেখা দেয়-
⇨ বুকের মাঝখানে চাপ
⇨ শ্বাস নিতে কষ্ট
⇨অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন
⇨ প্রচণ্ড ক্লান্তি
⇨ অস্থিরতা
⇨ কিছুক্ষণের জন্য চারপাশ ঝাপসা লাগা
তাহলে দ্রুত চিকিৎসাসেবা নেয়া জরুরি। এগুলো সাময়িক ধরে নিলে ক্ষতি বাড়তে পারে, কারণ হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা কখনো কখনো বিপজ্জনক মাত্রায় যেতে পারে।
চিকিৎসার অগ্রগতি,কীভাবে রোগীরা সুস্থ হন?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনায় রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। চিকিৎসার লক্ষ্য—
⇨ হৃদযন্ত্রকে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানো
⇨ স্ট্রেস হরমোনের প্রভাব কমানো
⇨ শরীরকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া
⇨ রক্তচাপ ও হৃৎকম্প স্বাভাবিক রাখা
সমর্থনব্যবস্থা ও মানসিক যত্ন এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক চাপজনিত অবস্থাকে অতিরঞ্জন ভেবে উপেক্ষা করা গুরুতর ভুল। কারণ, এই চাপই শারীরিক সমস্যার মূল চালিকা শক্তি।
মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রের সংযোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা ভয় ও আবেগ প্রক্রিয়াজাত করে। যখন এটি অতিরিক্ত সক্রিয় হয়, স্নায়ুতন্ত্র হৃদযন্ত্রে সংকট সংকেত পাঠাতে শুরু করে। এই সংযোগের কারণেই মানসিক আঘাত সরাসরি হৃদযন্ত্রে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, মানুষ শুধু মনের দুঃখে কাঁদে না, হৃদযন্ত্রও প্রতিক্রিয়া দেখায়।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
চিকিৎসকের মূল পরামর্শ-মানসিক চাপকে অবহেলা নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা। পর্যাপ্ত ঘুম,শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, ধ্যান, নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, কথা বলা, নিজেকে একা না রাখা- বড় আঘাতের পর মানসিক সহায়তা গ্রহণ। এসবই হৃদযন্ত্রকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
মানুষের মনের কষ্ট কখনো কখনো শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে আহত করে। ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম তার প্রমাণ। এটি কোনো গল্প বা আবেগপ্রবণ শব্দ নয়, বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বীকৃত বাস্তবতা। মানসিক আঘাত সাময়িক হতে পারে, কিন্তু তার প্রভাব হৃদযন্ত্রে তীব্র হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা খুবই স্পষ্ট- মানসিক চাপ ও আবেগের ঝাঁকুনি অনুভব করলে তা কখনোই হালকা করে দেখবেন না। মনের যত্নই হতে পারে হৃদযন্ত্র রক্ষার প্রথম শর্ত।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।